গমক ঘর

ছায়াছবি-কথা – ৭

আগের পর্বে

কোনো সাজানো পটভূমি নয়। ক্যামেরার কারসাজিও নয়। বাস্তবের কিছু মুহূর্ত, সাধারণ ভিডিও, টেলিভিশন ফুটেজ, ফেসবুক ফুটেজ জুড়ে জুড়ে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘের ছবি। ছবি বললে অবশ্য খানিকটা কম বলা হবে। বলা ভাল বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক হিংসার লিখিত দলিল। হিংস্রতার আখ্যান। ২০১৯ সালে সানাল কুমার শশিধরণ তাঁর চতুর্থ ছবি ‘ডেথ অফ ইনসেন’-এর মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন সমাজের অন্ধকার দিকটাই; দেখিয়েছিলেন পুলিশি জুলুম, নির্মমতা, ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রকে।

আমরা যেমন চলতি ভাষায় বলি - ‘দেশ-ঘর’ বা ‘দেশের বাড়ি’, এও তেমনই একটা পরিবারের গ্রামের বাড়ি। শান্ত, নিকোনো একটা বাড়ি। মাটির নয়, ইট-কাঠ-সিমেন্টেরই একতলা একটা বাড়ি। খানিক একলাটে হয়তো, কিন্তু একলা নয় তবু পাড়ায়। দালানের দেওয়াল সাদা, আর ঘরেরগুলো নীল। কাঠের কড়িবরগা, কলতলা, দালান, হেঁশেল। ঘেসো উঠোনে দেওয়ালঘেঁষা স্থলপদ্ম, টগর, জবাগাছ। তুলসীমঞ্চের গায়ে রোদ পড়ে, বৃষ্টি পড়ে, শীতকুয়াশা জড়িয়ে ধরে। গ্রামের নাম মধুপুরা। দ্বারভাঙা জেলা। বিহার রাজ্য। মৈথিলী ভাষার ছবি-- গমক ঘর (২০১৯)। পরিচালক-- অচল মিশ্র। বয়স - ২৩।

এ ছবিকে গতানুগতিক অর্থে ন্যূনবাদী (মিনিমালিস্ট) না ব’লে বলা যাক পরিমিতির প্রাচুর্যভরা আখ্যান। আবার আখ্যানকে গপ্পো ভেবে ফেলার (বদ)অভ্যাস থেকে কিছু ছবিকে নন-ন্যারেটিভ বা আখ্যানহীন ছবির তকমা দেওয়া হয়ে থাকে। আখ্যানহীন চলচ্চিত্র আদৌ হওয়া সম্ভব কিনা সেই তর্কে না গিয়েও বলা যায়, এ ছবিতে আখ্যানের উপস্থিতি স্পষ্ট। কিন্তু ছবিটা যা দেখায় তা আখ্যান নয়, যেভাবে দেখায় আখ্যান সেটা। অন্তস্থিত সাধারণ নিরীক্ষকের মতো চোখ চেয়ে বাড়িটাকে দেখতে থাকে ছবিটা। ক্যামেরা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে স্থিরদৃষ্টে, ট্যাবলো ভিভাঁর ঢঙে। (অপেক্ষমাণ) ক্যামেরা একই জায়গা থেকে দেখে কীভাবে দালানের থামে সকালের রোদ রং বদলে, ঢং বদলে শেষ বিকেলে খোপ-কাটা নকশা হয়ে যায়। আপাত একটা আন্তরিক-নির্লিপ্তি ছেয়ে থাকে ছবিটাকে। শট নেওয়া হয় খুব সাদাসিধেভাবে ফ্রেম করে, মানুষের চোখের সমতলে। কিন্তু প্রতিটা ফ্রেম নিখুঁত পরিপাট্যে সাজানো, বাড়িটার মতোই। 

এই সহজ-সরল ভাবটাই ছবিটার অন্তর্নিহিত ঐশ্বর্য। বাড়িটা যেন একটা থিয়েটরের মঞ্চ - কখনো তা উৎসবের আবহে লোকেজনে খেলাধুলোয় হাসিগানে তাসের আড্ডায় ভরে ওঠে, আবার কখনো গালে হাত দিয়ে বসে থাকে অপলকে। কিন্তু কোনোটাই উচ্চকিত কিছু নয়, যদিও ক্যামেরার সামনের মানুষগুলোকে কলের পুতুল ভাবলে একেবারেই ভুল করা হবে। কোনও দৃশ্যে বা সংলাপে নিম্নরেখা করা নেই। চিহ্নমূলক আর জাত্যর্থবাচক অর্থ এখানে আলাদাভাবে ‘বোঝার’ দরকার পড়ে না। এই ছবিতে দেখনদারি নেই পরিবর্তনশীলতার দুনিয়াদারিতে। ঋতু আসে, ঋতু যায়। পরিবারের কেউ অন্যত্র থাকতে চলে যায় উর্ধ্বগামী গতিশীলতার চাহিদায়, কাঠের চেয়ারের পাশে প্লাস্টিকের চেয়ার আসে, টাংস্টেনের হলুদ বাল্বের জায়গায় আসে এলইডি বাল্ব, নতুন দোতলা বাড়ি ওঠে পেছনে, অ্যানালগের জায়গা নেয় ডিএসএলআর কি কুলপিক্স ক্যামেরা, অ্যাম্বাস্যাডার গাড়ির জায়গা নেয় ডিজায়ার, স্কুটারের জায়গায় বাইক, আসে মোবাইল। তাকালে এসব কিছুই চোখে পড়ে না। দেখলে বোঝা যায়-- বাড়িটা, একটা স্থির দেওয়াল ঘড়ির মতো, সময়ে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে যেন। যেন বাড়িটা নয়, আমরা সাক্ষী থাকছি শুধুই একটা সময়ের। পার্থিবতার অনন্তরূপ নিয়ে হাজির হয় ছবিটা।

 

আরও পড়ুন
স্বপ্নোন্মাদের মৃত্যু

দেড় ঘণ্টা দৈর্ঘের এই ছবিটার, মোটের ওপর সমান ভাগে ভাগ করা, তিনটে পর্ব। ১৯৯৮-এর গ্রীষ্ম, ২০১০-এর শরৎ, ২০১৯-এর শীত। ছবি যখন ১৯৯৮-তে, তখন ফ্রেমের অনুপাত (অ্যাস্পেক্ট রেশিও)-- ৪:৩। ছবি যখন ২০১০-এ, তখন ফ্রেমের অনুপাত-- ১৬:৯। ছবি যখন ২০১৯-এ‌ তখন-- সিনেমাস্কোপ। প্রতিটা পর্বই কিছু অপরূপ পল্লীগ্রামের প্রাকৃতিক নিসর্গ দৃশ্য দিয়ে শুরু হয়। আর শেষ হয় দালানে চড়ুইপাখির খেলা দিয়ে। একমাত্র একবার আমবাগান আর দু’বার ছট পুজো আর একবার চা-দোকান ছাড়া ক্যামেরা বাড়ি, বাড়ির গলিটা ছেড়ে নড়েনা-- ঘরকুনো আত্মার মতো। পাতা পড়ার শব্দ শোনা যাবে এমন বেড়ালের চলনের মতো আলতোভাবে ক্যামেরাটা উঠোনে, দালানে, ঘরে, রান্নাঘরে, ছাদে দেখে বেড়ায়-- না ব’লে বরং বাড়িটাই যেন তার বাসিন্দাদের দেখে, আত্মীয়কুটুমদের দেখে-- এমনটা বলা সুপ্রযুক্ত হবে হয়ত। অনেকটা যেন নিঃশব্দে দেওয়াল বেয়ে লতিয়ে থাকা মানি প্ল্যান্ট কি বোগেনভ্যলিয়ার মতো। বাড়িটাই কথক, বাড়িটা হোমোডায়জেটিক ন্যারেটর-- যদিও আবহকণ্ঠহীন।

‘ছবিটায়-জাস্ট-কিচ্ছু-হয়-না’-- ব’লে একটা লব্জ প্রচলিত আছে সিনেমা-মহলে। অর্থাৎ ঘটনার ঘনঘটাহীন, সূচনা-মধ্য-অন্তযুক্ত বক্র-রেখচিত্রের কায়দায় গল্প-বলার প্রশ্নে দায়হীন, চলচ্চিত্র মাধ্যমটির দৃশ্য-শ্রাব্যতার স্ব দিয়ে চালিত হতে চাওয়া এক জাতের ছবি। এ জাতীয় ছবির মূল রাজনীতি এদের ধীরতা। এই ধী স্থান আর কালের স্বায়ত্তে বিশ্বাসী। ধ্যানপরায়ণী পর্যবেক্ষণ এর মূল শক্তির জায়গা। এখানে এক-একটা শট অথবা দৃশ্য হয়ে ওঠে সদাসঞ্চরমান সময়ের আক্ষরিক ও সৎ নামান্তর। গমক ঘরে কিন্তু আস্ত একটা অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান হয়। সেসবের যোগাড়যন্ত্র থেকে শুরু করে; সেখানে ধর্মীয় আচার পালন হয়, নেমন্তন্ন খেতে আসে পাড়া-প্রতিবেশী, রাতে ভিসিডি-প্লেয়ার ভাড়া করে এনে ফিল্ম দেখা হয়। মাছ-দই-মিষ্টি-আম কোনোকিছুরই অভাব থাকেনা, কিন্তু সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খ-দেখিয়ে-বাজিমাত করার বোধ উৎপাদন না করে বরং নির্দিষ্ট পরিসরটির সাংস্কৃতিক ধাঁচা বুঝতে সাহায্য করে। পারিবারিক ফটো-অ্যালবাম থেকে, পুরনো ফর্দ-খাতা থেকে ইতিহাসের সঙ্গে এক সহজ সংলাপে রত হয় বর্তমান। আর সেভাবেই ভবিষ্যতের দিকে এক অনিবার্য যাত্রার অনুভব হয়। 

 

সাধারণভাবে প্রাপ্ত আলোর পাশাপাশি এমনভাবে বাইরের আলো প্রযুক্ত হয়, যা দেখে মনে হয় সন্ধ্যের মুখে কবিতার বই খুলে বসলে যেটুকু আলো পেলে চোখের সুবিধে হয় ততটুকুই যেনবা রাখা হয়েছে। আনন্দ বনসল-এর ক্যামেরা আর অভনি গোয়েল-এর শিল্প পরিকল্পনা বাড়িটাকে একটা জ্যান্ত জাদুঘর ক’রে তোলে। বাস্তববাদের বিন্দুমাত্র ঘোষণা না থেকেও ছবিটা পার্থিব ‘সংসার’-কে যেভাবে দেখায় তাকে অপার্থিব-বাস্তবতা বলা ছাড়া উপায় থাকে না। আর সেই অপার্থিবতা তৈরী করে ছবিটার শীতল রঙ-সম্পৃক্তি (কালর স্যাচুরেশন)। আবহসংগীত সংলাপের বিকল্প হিসেবে ‘ব্যবহৃত’ হয় বলে বোধ হয়। মনে হয় অনুভূতির সার্বজনীনতা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে সাংগীতিক বিমূর্ততা দিয়ে, যা ছবিটার স্থান-কাল নির্দিষ্টতার মূল সুরকে খানিক হলেও বাধাপ্রাপ্ত করে। খানিক জনপ্রিয় কায়দায় স্মৃতিবেদনার দরজায় কড়া নাড়ার আকুলতা কানে আসে। একইভাবে, বারান্দার ফাঁকা খাট বা বারান্দায় ছড়িয়ে থাকা চেয়ার টেবিলের শট প্রতীকীবাদী ঝোঁক বলে মনে হয়।

আরও পড়ুন
মধুর রাজ্য

গ্রামের বাড়ি অর্থাৎ এ ছবির মূল চরিত্রের বিকাশও হয় কিন্তু। বাড়িটা আগের রূপে থাকছে না আর। এবার বাড়িটা ঢালাই করতে হবে সামনের অনুষ্ঠানের আগেই। তাই খুলে ফেলা হচ্ছে বাঁশের সজ্জা, বাঁশের সজ্জার ওপর অ্যাসবেস্টস, তার ওপর সাজানো টালি, দাদুর ছবির ফ্রেম। আত্মজীবনীমূলক ছবির কথা আমরা শুনেছি-দেখেছি, সব ছবিই যে শেষ প্রস্তাবে আত্মজৈবনিক তাও জানিয়েছেন নব তরঙ্গের চলচ্চিত্র-শিক্ষক; কিন্তু নিজের গল্প বলতে গিয়ে তা যদি দর্শকের স্মৃতিকে জ্যান্ত ক’রে তোলে ভয়ানক সরল-সাবলীলতায়-- সে ছবির সার্থকতার ঘ্রাণ রসবেত্তাদের নাগালে আসে সহজেই।

Powered by Froala Editor