বিধানচন্দ্র রায়, কল্যাণী ও ‘অপূর্ণ প্রেম’ : মিথ ও মিথ্যের আড়ালে

বিধানচন্দ্র রায় এক অসামান্য চিকিৎসক, যাঁর দুর্ধর্ষ এক ক্লিনিক্যাল আই ছিল, প্রশ্নাতীত রোগ নির্ণয় ক্ষমতা, বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী, একদা কলকাতার মহানাগরিক, বিদেশ থেকে পাশ করে আসা এমআরসিপি, এফআরসিএস-এর ডিগ্রি; তাঁর এসব পরিচয় এখন বাঙালির কাছে অতীত। কেবল রয়ে গিয়েছে বিধান রায় আর নীলরতন সরকারের মেয়ে, কল্যাণীর না পাওয়া প্রেমের গল্প। এ গল্প বাঙালির মুখে-মুখে, সর্বত্র শুধুই অপূর্ন প্রেমের প্রতি বিধান রায়ের আনুগত্যের কথা।  

আসলে, আমরা অপ্রাপ্তির গল্প শুনতে ভালোবাসি। না পাওয়াতেই সুখ খোঁজে আমাদের অবচেতন মন। ওই যে বলে না দুঃখের গল্প গুলো আমাদের হৃদয়ের বড্ড কাছাকাছি থাকে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে, একে না পাওয়া প্রেমকাহিনি, তারপরে এমন বিখ্যাত মানুষদের জীবনের ঘটনা। মানুষ যে সরস গল্প ফাঁদবেই, সে কথা বলাই বাহুল্য! 

আর কী! এভাবেই বছরের পর বছর এই গল্প চলতেই থাকল আর বাড়তেই থাকল, টিভি, রেডিও, ইন্টারনেট, ইউটিউব, পোর্টাল থেকে সাধারণ জনমানসে, সর্বত্র শুধুই বিধান আর কল্যাণীর প্রেমের গল্প। 

ডিডিএলজে-র অমরেশ পুরীর মতো নীলরতন সরকার সে গল্পে, রাগী বাবার ভূমিকায়। কিন্তু সিনেমার মতো শেষটা ভালো হল না, মানে মধুরেণ সমাপয়েৎ হল না। ব্যাস, গল্প জমে ক্ষীর। আর লোকজনকে এ-গল্প বলা থেকে আটকাবেন কী করে। বাংলার কাঁথি থেকে কলকাতা, আট থেকে আটান্ন হয়ে আশি সবাই এই কাহিনি বলে বেশ আত্মতৃপ্তি নিয়ে আসছে আজ প্রায় পাঁচ-ছয় দশক যাবৎ।  

আরও পড়ুন
লাহোর থেকে ছদ্মবেশে কলকাতায়; বিধান সরণির এই বাড়িতেই লুকিয়ে ছিলেন ভগৎ সিং

হয়তো আজ কোথাও কোথাও বিধান রায়ের সঙ্গে এক মহিলার ছবিও ভেসে আসতে দেখতে পারেন, নিউজ ফিড স্ক্রল করতে করতে। দেখবেন লেখা আছে কল্যাণীর সঙ্গে বিধান, তা কিন্তু নয়, ওই ছবিতে বিধান রায়ের সঙ্গের মহিলাটি হলেন বিধান রায়ের মা অঘোরকামিনী দেবী। 

আরও পড়ুন
হাসপাতালের নাম হবে রাধাগোবিন্দ করের নামেই, লক্ষাধিক টাকার প্রস্তাব ফিরিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র

এবার আসি যাকে নিয়ে এত কথা  সেই কল্যাণীর কথায়, প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী তিনি নীলরতন সরকারের কন্যা। একটু ঢুঁ মারা যাক এর আর এস-এর ফ্যামিলি ট্রি-তে। নীলরতন সরকার পাঁচ কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন, তাঁরা হলেন নলিনী বসু, অরুন্ধতী চ্যাটার্জি, শান্তা সেন, মীরা সেন এবং কমলা চ্যাটার্জি। এদের স্বামীরা হলেন যথাক্রমে, ডা: ডি এন বসু,কেদারনাথ চ্যাটার্জি, ভি এন সেন, সুশীল কুমার সেন, অশোক চ্যাটার্জি এবং অশোক চ্যাটার্জি। এরা প্রত্যেকেই তদানীন্তন সমাজের সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, কেউ অধ্যাপক, কেউ সাংবাদিক, আবার এদের মধ্যে বিজ্ঞানী, শিল্প উদ্যোগীও রয়েছেন। এছাড়াও নীলরতন সরকারের একজন পুত্রও ছিলেন, তিনি হলেন অরুণ প্রকাশ সরকার।

 কিন্তু কোথায় গেলেন বিধান রায়ের প্রেমিকা? ভারী আশ্চর্যের বিষয়! কোথায় আর যাবেন! ওই নামে নীলরতন সারকারের কোনো সন্তানই ছিল না। তাহলে মেয়ে আসবেনই বা কোথা থেকে, মেয়ে থাকলে তবে না প্রেম, তারপরে বিয়ে দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্ন। 

এর সঙ্গে অনেকেই আরেক গল্প জুড়ে পরিবেশন করেন। যেমন মেয়ের সঙ্গে বিয়ে না দেওয়ায় কারণে নীলরতন সরকারের সঙ্গে এরপর বিধান রায়ের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়,তাও এক ভ্রান্ত প্রচার বই কিছুই না। নীলরতন সরকার সঙ্গে বিধান রায়ের বরাবার সুসম্পর্ক বজায় ছিল, তিনি নীল রতনের চিকিৎসাও করতেন। নীল রতনের স্ত্রী নির্মলা দেবী ১৯৩৯ সালের মারা যাওয়ার পরে,১৯৪০ নীলরতনের স্ট্রোক হয়, সেই সঙ্গে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও। এই রোগ থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পরে বিধান রায়ের পরামর্শেই তিনি পুরী বেড়াতে গিয়েছিলেন। 

তাহলে কল্যাণী নামটা কীভাবে এল? 

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলেছে। বিভিন্ন জায়গায় মার্কিনি সেনা ব্যারাক তৈরি করা হচ্ছে জোরকদমে। কলকাতা থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে মার্কিনি সেনা ঘাঁটি ‘রুজভেল্ট নগর’ গড়ে তোলা হল। বিমান ঘাঁটি, সেনানিবাস, সেনা হাসপাতাল কী ছিল না সেখানে। কাছেই ‘চাঁদমারি হল্ট' স্টেশন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, গঙ্গার ধারের নদিয়া জেলার ৪৫টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল নগরী। যার পরিকল্পনার নেপথ্যে ছিলেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। 

এরপর স্তিমিত হয়ে এল বিশ্বযুদ্ধ, আত্মসমর্পণ করল হিটলারের জার্মানি। পরমাণু বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত জাপান পরাজয় স্বীকার করে নিল। তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাকাপাকি ভাবে ভারত থেকে বিদায় নিল মার্কিনি সেনারাও। 

তাদের জন্যে তৈরি ব্যারাক, সেনা ছাউনি, বিমান ঘাঁটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকল। জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছে রুজভেল্ট নগরী। তারপর, পঞ্চাশের দশকে বিধান রায় ঠিক করলেন দ্বিতীয় কলকাতা তৈরি করবেন। রাস্তাঘাট, পার্ক, নর্দমা একেবারে পরিকল্পনা মাফিক শহর হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা শিল্প যোগাযোগ সব ক্ষেত্রেই সেরা হবে সেই শহর।

 ১৯৫০ সালে মাস্টার প্ল্যান তৈরি হল, ১৯৫১ সালে শিলান্যাস করলেন তৎকালীন রাজ্যপাল কৈলাশনাথ কাটজু। ১৯৫৪ সালে ‘চাঁদমারি হল্ট’ স্টেশনের নতুন নামকরণ হল ‘কল্যাণী’। এরপর ধীরে ধীরে পুরো শহরের নামই হয়ে গেল কল্যাণী। এই শহর ছিল কলকাতা থেকে দূরে, ফলে দূষণ মুক্ত পরিবেশ। সেই সঙ্গে সব দিকেই মিলবে সুপরিষেবা। অতএব, এখানে থাকলে মানুষের কল্যাণ হবে। আর যেকোনো শহরকেই আমরা অনেক সময় স্ত্রীলিঙ্গ ধরি, তার সৌন্দর্য, রূপ বর্ণনা করতে। ঠিক যেমন কল্লোলিনী কলকাতা, বা তিলোত্তমা; সেইভাবেই কল্যাণ এর সঙ্গেই জুড়ে হয়ে গেল কল্যাণী। আর তৈরি হল সরস মশলাদার গল্প। যা আজও আমাদের মনোরঞ্জন করে আসছে। 

অনেকেই, বিয়ে না করার কারণ হিসেবে প্রেমে প্রত্যাখ্যানকেই উল্লেখ করেন, যেটা একেবারে ভিত্তিহীন একটি যুক্তি। এই বিয়ের প্রসঙ্গে তাঁর একটি ঘটনা আছে। তিনি আদ্যোপান্ত কাজ পাগল মানুষ ছিলেন। বিধানচন্দ্র রায়, ১৯৫৫ সালে কোনো একদিন দিল্লি-বোম্বাই ঘুরে করে বিমানে কলকাতা ফিরলেন দুপুর একটায়। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন মহাকরণে, বাড়ি ফিরলেন যখন ঘড়িতে তখন সাড়ে ৭টা বাজে। বিধান রায়ের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনীকার টমাস তাঁর বাড়িতেই বসেছিলেন কাজের জন্যে, কিছু ছবির সম্পর্কে তিনি তাঁর থেকে শুনে নিয়ে লিখবেন, কিন্তু ডা. রায় ফিরে আসার পর থেকেই রাইটারসের ফাইলের মধ্যে ডুবে আছেন। রাত সাড়ে ৯টা, তখনও তিনি পড়ে যাচ্ছেন।

লজ্জিত টমাস বললেন, এখন আপনার ঘুমানোর সময়। তিনি অভিপ্রেত উত্তরই দিয়েছিলেন, "তা হলে আমার কাজগুলো কে করবে?"

টমাস বললেন, কাজের একটা সীমা থাকা উচিত। আপনি বিয়ে করেননি, তাই চলছে। আপনার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা থাকলে তাঁরা আপনাকে বিশ্রামের কথা বলতেন। ডাক্তারবাবু  তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন, আপনি জানেন না? কাজের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে!

এই ভাবেই আমরা মশলাদার গল্পে তাঁর অকৃতদার থেকে যাওয়াকে মিলিয়ে দিয়েছি। না পাওয়া প্রেমিকার গল্প, মিথ হয়ে গিয়েছে,  ইতিহাস এবং কার্যত এক কিংবদন্তির জায়গায় নিয়েছে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মনে, তাঁরাও একে সত্যি ভেবে আসছেন যুগ যুগ ধরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুনে আসছে এই মিথ্যে প্রচার। 

তথ্য সূত্র :
১. অধ্যাপক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়-এর প্রবন্ধ।
২. কল্যাণী পৌরসভা কর্তৃক প্রকাশিত ‘পুরকথা’ পত্রিকা।
৩. ব্যাক্তিগত কিছু গবেষণা।

Powered by Froala Editor