প্রায়ই সময় কাটাতেন শ্মশানে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই গলায় দড়ি দিলেন পান্নালাল

রেকর্ড, ক্যাসেটের যুগ কেটে গেছে বহুদিন। ধীরে ধীরে সাধারণ মার্কেট থেকে সরে যাচ্ছে সিডিও। এখন ইন্টারনেটের যুগে একটিমাত্র ক্লিকে আমরা শুনতে পাচ্ছি সুদূর অতীত থেকে শুরু করে আজকের যুগের গানও। কিন্তু কালীপূজা এলেই যে অমৃতকণ্ঠে গীত শ্যামাসঙ্গীত এখনও আমাদের মুগ্ধ করে, যে কণ্ঠে ‘আমার সাধ না মিটিল’, ‘মায়ের পায়ে জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন’, ‘সকলি তোমারই ইচ্ছা’ ইত্যাদি গানগুলি না শুনলে যেন মনে হয় কালীপূজা সম্পূর্ণ হলই না, সেই কণ্ঠের অধিকারী সাধক-গায়ক আজও আমাদের চোখে এক পরম বিস্ময়! 

পান্নালাল ভট্টাচার্য। লোকান্তরিত হবার অর্ধশতাব্দীকাল পরেও তিনি ও ‘শ্যামাসঙ্গীত’ যেন সমার্থক। 

ধর্মে শাক্ত কিন্তু মন্ত্রে বৈষ্ণব বারেন্দ্র ভাদুড়ি বংশের সন্তান যোগাচার্য নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি ছিলেন মস্ত যোগীপুরুষ। যৌবনেই তিনি সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। যোগ তো বটেই, তার সঙ্গে শাস্ত্র, উপনিষদ এবং সঙ্গীতও ছিল তাঁর সাধনার বিষয়। নিজে গান লিখতেন, সুরও করতে পারতেন। তাঁর গান শুনে স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। যোগী নগেন্দ্রনাথের তিরোধান হয় ১৯২৬ সালে।

এই নগেন্দ্রনাথের ভাইপো হলেন সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য। পৌরহিত্য করার জন্য তাঁরা ভট্টাচার্য্য উপাধি লাভ করেন। সুরেন্দ্রনাথের আদি বাড়ি ছিল হাওড়া জেলার পায়রাটুঙি গ্রামে। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে সাংসারিক মনোমালিন্যের কারণে তিনি ভিটে ছেড়ে চলে যান সাঁতরাগাছিতে, আপন কুলগুরুর আবাসে। তাঁর নির্দেশে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কেউ ভিটেমুখো হননি কোনোদিন। এই আবাসেই তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয় অন্নপূর্ণা দেবীর। এঁদের ছয় ছেলে, সাত মেয়ে।

অন্নপূর্ণা দেবী প্রয়াতা হন ১৯৫৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। তখন তাঁর ছেলেমেয়েদের মধ্যে জীবিত ছিলেন মাত্র সাতজন। বহু মৃত্যু দেখতে হয়েছিল তাঁকে তাঁর জীবদ্দশায়। তাঁর বড়ো ছেলে ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত এবং তারপর তাঁর বড়ো মেয়ে ইন্দুমতী। তারপর তাঁর আরেক ছেলে, যিনি মারা যান অন্নপ্রাশনের ঠিক আগের দিন। এরপর তাঁর দুই মেয়ে। তারাও গত হন অল্পবয়সেই। এরপর জন্ম নেন তাঁর আরেক পুত্র ননীগোপাল। দুর্গাপুজোর সময় একজনের কাঁধে চেপে ঘুরতে ঘুরতে পড়ে গিয়ে মারা যান তিনিও। এরপর জন্ম নেন প্রফুল্ল ভট্টাচার্য্য, বাংলা সঙ্গীতজগতের পরিচিত নাম। তারপর এক মেয়ে শান্তিময়ী। তাঁর পরের জন হলেন বাংলা সঙ্গীতজগতের একটি যুগ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য। তারপর আরও দুই মেয়ে সরস্বতী ও টোকে। টোকে টাইফয়েডে মারা যান চার বছর বয়সে।

এরপর অন্নপূর্ণা দেবীর এক সন্তান যখন আট মাসের গর্ভে, তখন প্রয়াত হন তাঁর স্বামী সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, ১৯৩০ সালের ১৮ জানুয়ারি। এরপরে সাঁতরাগাছিতে উঠে আসেন তিনি এবং এখানেই মারা যান তাঁর বড়ো ছেলে লক্ষ্মীকান্ত। তারপর তিনি ওঠেন রামরাজাতলায় নারায়ণ তেলির বাড়িতে। এখানেই ৫ মার্চ, বুধবার জন্ম হয় কিংবদন্তি শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য্যের। এরপর তাঁর ভাই ভবরাম লাহিড়ী তাঁকে বালি নিয়ে আসেন। সেখানে কিছুদিন ভাড়া বাড়িতে থেকে বাপের বাড়ির এক খণ্ড জমিতেই থাকতে শুরু করেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
ফুটবল খেলতে গিয়ে চোখে আঘাত; সিনেমার জন্য দাদার কাছে চড়ও খেয়েছেন পান্নালাল

স্বামীর মৃত্যুর জন্য সর্বকনিষ্ঠ সন্তান পানুকেই দায়ী করতেন তিনি। বাপমরা ছেলেটির বাবা-মা দুইই যেন ছিলেন তাঁর দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য। শ্যামাসঙ্গীতেও তাঁকে নিয়ে গেছিলেন এই দাদাই। পান্নালালকে গাইতে বললেন শ্যামাসঙ্গীত আর পান্নালালের বন্ধু সনৎ সিংহকে গাইতে বললেন ছড়ার গান। কারণ, তখনকার দিনের প্রখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গানের জগতে নাম করা সহজ ছিল না। এই করে শ্যামাসঙ্গীতে পান্নালাল এমন নাম করলেন যে কে. মল্লিক (মুন্সী মহম্মদ মল্লিক), মৃণালকান্তি ঘোষ, ভবানীচরণ দাস প্রমুখ সেকালের মায়ের গানের প্রখ্যাত শিল্পীদের পরে দীর্ঘদিন ধরে মাত্র এই একটি নামই উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ছিল এবং এখনও যে পান্নালাল কতখানি জনপ্রিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ পান্নালালের প্রথম রেকর্ড কিন্তু আধুনিক গানের। এক পিঠে ছিল রামকৃষ্ণ চন্দের কথায় ‘শিল্পের বেলা খেলার ছলে’ এবং অমিত ভট্টাচার্য্যের কথায় ‘সেদিনের সেই গানখানি’; সুর দিয়েছিলেন ধীরেন ভট্টাচার্য্য।

শৈশব থেকে সাধক-গায়ক হয়ে ওঠা পান্নালালের কথা বলতে শুরু করব শেষ থেকে। সেই শেষ এখনও অত্যন্ত বিস্ময়ের, কত কিংবদন্তি, কতই না রহস্যে মোড়া।

দুটি শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ড করবেন পান্নালাল। রামপ্রসাদ সেনের লেখা ‘অপার সংসার নাহি পারাপার’ এবং অসিতকুমার বসুর লেখা ‘ওদের মত বলব না মা আমায় তুমি কর পার’। তখন ‘মা’ ‘মা’ করতেন পান্নালাল। সময় পেলেই চলে যেতেন শ্মশানে। জীবনে ঘটে গেছে অনেক অলৌকিক ঘটনা। ঘরে বসে সেই পান্নালালকে এই দুটো গান তোলাচ্ছেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য। সুর করেছেন তিনি এবং দাদা প্রফুল্ল ভট্টাচার্য্য। একটা ছোট্ট জায়গা বারবার ভুল করছিলেন পান্নালাল। ব্যাস, কিছুক্ষণের মধ্যেই সাংঘাতিক বকাবকি আরম্ভ করলেন ধনঞ্জয়বাবু। সেই চেঁচামেচি শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন ধনঞ্জয়-ঘরণী। তিন মেয়ের বাপ ছত্রিশ বছরের এক ছেলেকে এইভাবে কেউ বকে? তাঁকে ধমকে তাড়িয়ে দিলেন তিনি। পান্নালাল কিন্তু দাদা-বৌদিকে বাবা-মা জ্ঞান করতেন। অগ্রজর ধমক তাই সহ্য করতেন নীরবে। দাদা তাঁকে কত ভালোবাসেন তাও জানতেন তিনি।

আরও পড়ুন
‘আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানিনে মা’ – ১০৪ বছর বয়সেও আড়ালেই গানটির স্রষ্টা

স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে পান্নালাল

 

তো রেকর্ডিং শেষ হল। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে বাড়ি পর্যন্ত বকতে বকতে এলেন ধনঞ্জয়। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, পানু কেমন গাইল। ধনঞ্জয় বললেন, বাঁদরটার কাছে যা চেয়েছিলাম তার ষাট ভাগ পেলাম। উত্তরে পান্নালাল বলেছিলেন, সব যদি তোমার মতো পারতাম তাহলে আমিই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য হয়ে যেতাম।

এর মাত্র কয়েকদিন পরের ঘটনা। ২৬ মার্চ, ১৯৬৬ সাল। রবিবার। কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিলেন পান্নালাল। কারণ কী, জানা যায় না স্পষ্ট। সকালে তাঁর ভাইপো অর্থাৎ ধনঞ্জয়বাবুর বড়ো ছেলে শ্যামলাল গঙ্গাস্নান করে এসে দেখলেন তাঁর ছোটোমাসি গোমড়া মুখে বসে। চাপাচাপির পর বললেন, পানু আর নেই! ঘুমোচ্ছিলেন ধনঞ্জয়। তাঁকে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া হল দুঃসংবাদ। দাদা তাঁকে বললেন, ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে, পানু আর নেই!’ সে শুনে কাঁপতে লাগলেন ধনঞ্জয়। তাঁর পৃথিবী যেন শূন্য হয়ে গেল নিমেষে!

আরও পড়ুন
পান্নালাল ভট্টাচার্যকেও রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলিয়েছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়

আকাশবাণীতে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে সেই দুঃসংবাদ। তাঁদের সিসিলের বাড়িতে নিয়ে আসা হল পান্নালালের দেহ ধনঞ্জয়ের স্ত্রী-কে দেখাতে। তিনি তখন খুব অসুস্থ। অনেকে মিলে তাঁকে গাড়ির কাছে ধরে আনতে আছাড়ে পড়লেন পুত্রসম পানুর ওপর। কী অভিশপ্ত সেই দিন!

দাহ করে বাড়ি ফিরে ধনঞ্জয়বাবু কেঁদে কেঁদে একটানা বলে চললেন, আয় পানু ফিরে আয় বাবা! আর কোনোদিন তোকে বকব না, ফিরে আয়! তাঁর পুত্রসম আদরের ভাই তখন চলে গেছেন মায়ের কাছে ইহলোকের মায়া কাটিয়ে। মাকে দেখাই যে ছিল তাঁর জীবনে শেষ ইচ্ছা!

(দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন)

তথ্যসূত্রঃ

১) শ্যামলাল ভট্টাচার্য, ‘সুখী গৃহকোণ’ (জানুয়ারি, ২০০৮)
২) ‘দেবদত্ত’ পুস্তিকা (‘ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য স্মৃতি সংসদ’ থেকে প্রকাশিত)
৩) দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ (১৬ অক্টোবর, ২০১৪)
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ দিব্যেন্দু দে ও সপ্তর্ষি ঘটক

Powered by Froala Editor

More From Author See More