বিদ্যে কলমলোচনে

দেবের সময়ে বসে ব্যসদেবের সিলেবাসচর্চা, শুনতে অদ্ভুত লাগলেও বিষয় খানিক তাই। জীবন আমার জন্য ধার্য করেছেন কুল। দেবী সরস্বতীর মতোই আমার সাধনার পাশে একটি কুল এবং ডেডলাইন রেখে যাওয়া হয়েছে। একে বিদ্যার দেবী রুষ্ট, তাঁর উপর তাঁকে নিয়ে রম্য লেখার দুঃসাহস, বিদ্যার যে নিম্নমুখী ধ্বস আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে তা জানতে পারলে রাত্রে ঘুম আসবে না বাড়ির কারুর। মা খুবই সহজ আমার সঙ্গে, তবে লেখাপড়ার ব্যাপারে, থাক আর নাই বা বললাম। একদিন নিমবেগুনের তরকারি খাব না বললেও দেবী সরস্বতী রুষ্ট হয়ে যাবেন বলেই বিশ্বাস করানো হত আমাকে। আমার তাই কুল নিয়ে কোনও দ্বিধা ছিল না। পুজোর আগে কুল খেলে পরীক্ষায় নম্বর কমতে পারে এ বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। অতিরিক্ত পড়াশুনা করে তাই নিজেকে তুলে আনার থেকে কুলকে দোষ দেওয়াই অধিকতর কুল মনে করে এসেছি আমি। 

ঠাকুরের কৃপায় ডান কানটিতে খুবই কম শুনছি গত কয়েকমাস। কেউ সামনে এসে দাঁড়ালে তাই বাঁদিক ফিরে যাই, নিজেকে আয়নায় দেখে তাই কান বাড়িয়ে দিই, প্রশ্ন করি, তারপর উত্তরও দিই নিজেই... কুল নিয়ে লিখতে হবে না-হয় বুঝলাম কিন্তু উচ্চারণ কানে এল না স্বভাবতই। তাই কর্ম না করে ফলের কথাই ভেবে নিলাম। মনে পড়ল চাটনির গল্প। ক্লাস সিক্সে শ্রবণ নামক এক বন্ধু স্যারের কাছে বেধরক মার খায়। সেবছর আমরা স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপে জায়গা পেয়েছি সরস্বতী পুজোর। যে যার ক্ষমতার জায়গা খুঁজে নিচ্ছি কাজের তালিকা থেকে। শ্রবণ সগর্বে স্যারকে জানায় ও কুলকুচি করে রেখে দেবে, ঠাকুর চাটনি বানিয়ে নিলেই হবে। গা গুলিয়ে উঠেছিল স্যারের, সেদিন আমরা কাঠের স্কেল গরম হতে দেখেছিলাম। ক্রন্দনরত শ্রবণ বুঝতে পেরেছিল যেকোনও বাক্যে স্পেসের কী ভূমিকা... মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর অবশেষে ওকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় কুল কুচানোর, তবে আমরা যারা এই ঘটনার সাক্ষী, পুজোর ভোগ খেতে বসে কেবলই হেসে গেছিলাম লাগাতার। 

সরস্বতী কি তাহলে কুল দেবী? আমাদের এই অঢেল দেব-দেবতাদের কারুর সঙ্গেই সেভাবে আর কোনও ফল জড়িয়ে দিইনি আমরা। যদি কল্পনাও করি গণেশ তাঁর ভাঙা দাঁতে হাতিবাগান বাজারের শক্ত পেয়ারা খাচ্ছেন, অথবা কার্তিকের হাতে পূর্ণিমার রাতে তোলা আপেল, এমন চর্চা মনে পড়ে না এখন অব্দি। শনিদেবের বাহনদের মধ্যে নাম শোনা যায় শিয়ালের, আর পঞ্চতন্ত্রর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আঙুর কোনোভাবেই শনিদেবের ফল হবে না। তাহলে কেবল দেবী সরস্বতীর নামে কেন চালানো হয় এই ফল? কেন বলা হয় পুজোর আগে এ ফল খাওয়া নিষিদ্ধ? কেবলই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নাকি বয়ঃসন্ধির কোনও ইশারা বাস করে এই নিষেধাজ্ঞায়? সরস্বতী বিদ্যার দেবী থেকে প্রমোটেড হয়েছেন ভালোবাসার দেবীতে। যেভাবে আমাদের স্পোর্টস মিনিস্টার সামলে এসেছেন ট্রান্সপোর্টও। 

এই প্রমোশন তিনি কী অর্থে নিয়েছেন জানি না, জিজ্ঞাসা করার সুযোগ বা সাহসও হবে বলে মনে হয় না কখনও। তবে যুগের সঙ্গে সবই যে বদলায় এবং এই বদলও ক্রমশ মানুষ তার অনুকূলে নিয়ে আসছে তা একেবারেই স্পষ্ট। ঠাকুরের এই অনুকূলে যাত্রা কারুর কাছে ভক্তির কারুর কাছে হাস্যকর, এই যেমন তিরিশ পেরিয়ে নিজেদের প্রৌঢ় দাবি করা আমরা পরের প্রজন্মের সবকিছুকেই তাদের বেহায়াপনা হিসাবে দেখে থাকি... যেমন সরস্বতী পুজোয় যুগলরা প্রেম করবে কেন? রিকশাভাড়া পুজোর দিনগুলোয় বেশি হবে কেন? বাইক জোড়ে চালানো হবে কেন? আমেরিকা অন্য দেশের কথা ভাবে না কেন? প্রিন্সেপ ঘাটের গায়ে ওষুধের দোকান নেই কেন? হাত ঘড়িতে এলার্ম বাজবে কেন? বইমেলায় সরস্বতীপুজো পড়বে না কেন? সুলভ শৌচালয় কেন জি’পে নেবে না? এসবই আসলে পরের প্রজন্মের দোষ। তারা অসময়ে কুল না খেলে বাকি জীবনটা আরও সহজ থাকত আমাদের। দেবী রুষ্ট হতেন না। প্যালেস্তাইন মুক্ত থাকত। বইমেলা ময়দানেই থেকে যেত। শঙ্খবাবু বেঁচে থাকতেন। আরও কত কী...

সময়ের এই অবক্ষয় আমাদের অন্ধ করেছে বহু আগেই। কী ছিল না মনে করতে করতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে কী আছের দিনগুলো। পরিবর্তন এক অপ্রতিরোধ্য সত্য, আমরা তা মেনে নিলে হয়তো খানিক সহজ হয় বেঁচে থাকা। খুব Cool কোনও থিমের উপর পুজো হবে পাড়ায় এবার। জানিয়ে গেছে হোয়াটসঅ্যাপ থিমের প্যান্ডেলে বিরাজ করবেন দেবী সরস্বতী। পুরস্কারের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে কয়েক জায়গায়। চাঁদাটা একটু বাড়িয়ে দিতে হবে এবার। বাতেলার ঝড়ে কখন যেন খেয়ালই করিনি পকেট ফাঁকা করে ফেলেছি নিজের। চাকরি ছেড়ে ঘরে বসে আছি আজ চার মাস অন্তত। এর ভুল দেখছি, ওর সমালোচনা করছি, আর দিন কেটে যাচ্ছে দিনের মতো। কুলটার মতো তাই পর্দা টানি নিজের খোপে। হে বিদ্যার দেবী, ডেডলাইনের আগে অন্তত একটি চাকরির খবর আসুক, পরচর্চার সাধনা ভেঙে মাথায় এসে পড়ুক আপনার আশীর্বাদ। কলমের সেবায় যেন কাটিয়ে ফেলতে পারি বাকি জীবন। ঠান্ডা হাওয়ার আঁচে যেন আর ভয় না লাগে প্রস্তুতির। সিলেবাস সত্যিই কি অনেকটা বাকি এখনও?

Powered by Froala Editor

Latest News See More