কারিগর

বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ১২

বন্যার মতো জল বেরিয়ে আসছে, বয়ে নামছে সিঁড়ি দিয়ে। তবে কি জোয়ার এল মরা মেলায়? আলো দেখতে পাব এবার তাহলে? ঘোর কাটতে আর কতক্ষণই বা লাগে... শৌচকর্ম সেরে রাগের মাথায় কেউ কল ঘুরিয়ে দিয়ে গেছেন এখানে। তাই প্লাস্টিকের পলকা কল ধরে রাখতে পারেনি আবেগ। কাঁপা গলায় আবৃত্তি শোনার মতো কান্নায় ফেটে পড়েছে সে। ভেসে যাচ্ছে দর্শক আসন। কোনোরকমে এসব কান্নাকাটি বাঁচিয়ে গিয়ে, খালি পেলাম একটা খোপ। মাথার উপরে ছোট্ট খোপে পাখা বসানো, সেখান থেকে ঝাঁঝালো গন্ধ উড়ে যাচ্ছে ফুড কোর্টের দিকে। যে-কোনো বৃহত্তর আয়োজনই যখন আমাদের ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামানো ছেড়ে দিই আমরা। এই যেমন এসব দেখার পরই মোমো খেতে ওদিকে ছুটে যাব, মনে থাকবে না কোনো কন্টামিনেশন। মনে থাকবে না কোন নোংরা জলে রান্না করে গিল্ডের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা...

আগের কোনো এক পর্বে ঘোষণা করেছি বইমেলার সবচেয়ে রঙিন জায়গা লিটল ম্যাগাজিনের বাথরুম। বিরলও বটে। এখানে খাতা, বই, মদের বোতল, গাঁজার কৌটো থেকে শুরু করে আস্ত কবি অব্দি কুড়িয়ে পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে। কয়েক বছর আগে অব্দি মহারাজ গিটার হাতে গান গাইত এই করিডোরে। আশিস-দেবরূপরা দেওয়াল লিখে যেত। ব্যবসা নিয়ে গভীরতম সব আলোচনা চলত এই কয়েকশো স্ক্যোয়ারফুট জায়গায়। সিগারেট নেভাতে বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে আগুন চাইত দমকলের ছেলেরা। প্রথম দুবছর এখানে পুরুষ বাথরুমে স্লোপ ও প্রতিবন্ধী বাথরুমে সিঁড়ি ছিল, এখন নাম বদলে সামাল দেওয়া গেছে এসব ডামাডোল। তবু কিছু হলেই খিস্তি খেয়ে যান মেলা কর্তৃপক্ষ। দেওয়ালের গায়ে বড় বড় অক্ষরে কীসব অভিযোগ লিখে যায় কারা... আলিমুদ্দিনের পর বোধহয় এত গভীর আলোচনা পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র এখানেই হয়ে থাকে। দেশের কী হবে, বই বিক্রির হাল ফিরছে না কেন, বইমেলায় মানুষ কেন ফিসফ্রাই খাবে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে কেমন কবিতা লেখা যাবে না আর ইত্যাদি... 

মেলার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বাথরুমের কোনো পুরষ্কার থাকলে বোধহয় বিনা দ্বিধায় জিতে যেত আমাদের এই বাথরুম। যেমন সুন্দর মেঝে, তেমন পরিষ্কার গোটা ঘর। ময়দানের অন্যতম সমস্যা ছিল এটি, খানিক সমাধান হয় মিলনমেলায় গিয়ে। তবে করুণাময়ী এসে যে সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিন্তি ঘটে তা আর বলার নয়। এবছর ১৮ই জানুয়ারি উদ্বোধন হয় মেলা, যদিও এর বহু আগে থেকে শুরু হয়ে যায় আয়োজন। খানিক দুর্গাপুজোর মতোই। এখানেও প্যান্ডেল, লাইট, মাইক কেবল বিগ্রহের সংখ্যা দুটি। গিল্ডের দুই প্রধান। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টেবিল না পাওয়া পত্রিকারা জানেন এই দুই ঠাকুর কতটা জাগ্রত...

তা আয়োজনের কথায় ফিরি, মেলা শুরুর আগে অন্তত তিন-চারদিন মাঠে যাওয়া হয়েছে এবছর। চারিদিকে শুধু কাঠের টুকরো, পেরেক আর হাতুড়ির শব্দ। ফাঁকা এই মাঠে এলে মনে হবে যেন বাংলা সাহিত্যের কফিন তৈরি করছি আমরা। সেখানে ঘুরছি ফিরছি আর খুঁজে নিচ্ছি চেনা কবরগুলি। বার্ষিক পরীক্ষা এগিয়ে আসার মতো দ্রুততায় কাজ চলছে সেখানে। শান্তিদা পকেট থেকে ওয়াকি টকি বার করে আলো জ্বালানোর নির্দেশ দিচ্ছেন মেলার। এক কথায় উজ্বল হয়ে উঠছে বীরভূম থেকে মেদিনীপুর, হুগলি থেকে বাঁকুড়ার বিভিন্ন আস্তানা। 

বইয়ের সঙ্গে দূর দূর অব্দি সম্পর্ক নেই এমন কয়েকজন মজুর গোল করে বসেছেন ফুড কোর্টের মাঠে। কর্পোরেটরা এখনও মেলায় ঢোকেনি। তাই কাঠের আঁচে চাপানো হয়েছে ভাত, সেই হাঁড়ির ভিতরেই স্টিলের টিফিন কৌটোতে ডাল সিদ্ধ বসেছে। পাশের কড়াইয়ে বাঁধাকপির তরকারি। দমকল আসেনি এখনও। বাথরুমের সামনে এসে বিড়ি খেতে বারণ করবার কেউ নেই। কেবল পর্যাপ্ত আলো আছে। আছে প্রচুর দিনমজুর আর তাদের বিভিন্ন ক্রাইসিস। যাকিছু নিজেদের মুঠোয় নিয়ে মশারি টাঙিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে তারা। যেসমস্ত বিষয় নিয়ে কোনো সংখ্যা হবে না, কোনো লেখা হবে না কোত্থাও। আমরা তাদের থেকে হাতুড়ি ধার চেয়ে এনে দেওয়াল তুলব প্রতিবেশী পত্রিকার মাঝে। তারপর পেরেকের ব্যথা সঙ্গে নিয়ে ফিরে যাবে হাতুড়ি তার পুরোনো আস্তানায়। 

মেলা নিয়ে বড় বড় স্মৃতিচারণ লেখা বিপ্লবীরা আমরা কি জানি মানুষগুলো কোথায় কীভাবে ঘুমায় রাত্রে? কীভাবে থাকে? কী খায় এই কটাদিন? কোথায় চার্জ হয় মোবাইল আর বাড়ির খোঁজ নেয় রোজ একবার? রাতে সন্তানের মুখ ভেসে ওঠে, মাঠের অন্ধকারে একরাশ হাসি ছড়িয়ে পড়ে অস্থায়ী ছাদের নীচে। 

হ্যাঁ, ঠিকই বলছি, বইমেলার সবচেয়ে রঙিন এই বাথরুমের ভিতর, ১৮ তারিখ সকাল অব্দি বিছানা পেতে মশারি টাঙিয়ে ঘুমিয়েছে তারা, আমাদের স্বপ্নের কারিগরেরা, আপনাকে একটা রঙিন মেলা উপহার দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে বলে... 

চিত্রগ্রাহক – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor