মানচিত্র

বইমেলা থেকে ফিরে ।। পর্ব ১৩

‘৬২৩ নম্বর স্টলটা কোনদিকে বলতে পারবেন?’ তাকিয়ে দেখি মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলার দু’হাত ভরা বই। কপালের ঘাম নেমে ভাসিয়ে দিচ্ছে চশমার ব্রিজ। অসহায়ের মতো জানাই, বলতে পারব না দিদি, আপনার কাছে ম্যাপ নেই? কিছুক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে জানান, নেই। বলেন ভূতের বই কিছু আছে কিনা, এই উত্তরে আমি সহমত হই ওঁর, জানাই, নেই। হাতে ঘাম মুছে এগিয়ে যান ভিতরদিকে। এবছর শুনলাম এখনও ম্যাপ আসেনি মেলায়। তার বদলে গেটের বাইরে কিউ আর দেওয়া হয়েছে, যা স্ক্যান করলেই খুলে যাচ্ছে মানচিত্র। সেন্ট্রাল পার্কের সাময়িক মানচিত্র, তার ভিতর না জেনেই বিরাজ করছি আমরা সকলে।

আমাদের সুখ-দুঃখ, ভালো লাগা-খারাপ লাগার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই অযৌক্তিক মানচিত্র, যেখানে ভিয়েতনামের গায়ে গা ঘেঁষে উপস্থিত ইউএসএ। অদ্ভুত এই সীমান্তে কোনো পাহারা নেই মাঝে কোনো সমুদ্র নেই, নেই যুদ্ধের দুশ্চিন্তা, বোমাবাজি। কিছু দূরেই বাংলাদেশ, পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে লাগবে মিনিট ছয়, ভিড় হলে সর্বোচ্চ পনেরো মিনিট। না লাগছে পাসপোর্ট, না ভিসা। সোজা হেঁটে ঢুকে যাচ্ছি গ্রেট ব্রিটেন। বন্ধুকে ফোনে ডিরেকশন দিচ্ছি পোল্যান্ড আসার, বাংলাদেশের সামনে ঘটিগরম খেতে খেতে সে ছুটে আসছে পোল্যান্ড, হাতের প্যাকেটে চৈতন্যের মৃত্যুরহস্য। যে গবেষণা করতে উড়িষ্যায় বছরের পর বছর কেটে গেছে লেখকের। 

এইসব হাসিঠাট্টার উপর ধুলো জমেছে সমাগমের। হাজার হাজার মানুষ তাতে হাঁটছেন, পায়ে পায়ে আরো ধুলো, কেটে যাচ্ছে মেলার প্রথম চারটে দিন। এরপর আচমকাই চোখে পড়ছে ম্যাপ। হার্ডকপি দেওয়া শুরু হয়েছে তাহলে। নিশ্চিন্ত হই ভদ্রমহিলার কথা ভেবে। একটি আস্ত কাগজ, রঙিন অফসেটে ছাপা সে বৃহৎ আকৃতির ম্যাপ সাত-ভাঁজ করে পকেটে ভরে বাচ্চার হাত ধরে হাঁটা লাগালেন যে ভদ্রলোক, আমি জানি ম্যাপ তাঁর কোনো কাজেই লাগবে না। একটু বাদে ফুড কোর্টের পাশে গিয়ে পেতে বসবেন হয়তো। নাকের সর্দি টেনে মুক্তমঞ্চের দিকে মুছে দেবে শিশুটি। মা বসেবে ৯ নম্বর গেটের উপর, তার কোল ঘেঁষে শিশুটি ৪ নম্বরে। বাবা বইমেলায় থেকেও অনুপস্থিত মানচিত্রে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবাক। 

অসম্পূর্ণ এই মানচিত্রের একজন নতুন দর্শক কোনোদিন জানবেন না এর চারিদিকের সাদা অংশ আসলে বৈঠকখানার ব্যস্ততা। যা আমরা লিখে বোঝাতে পারব না বলে ব্ল্যাঙ্ক ছেড়ে দিয়েছি পাঠকের হাতে। বৈঠকখানা মেলার কদিন বন্ধ থাকলে হয়তো বইমেলাও অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। অর্ধেক বই এসে পৌঁছবে না সময়ে। এই এত আয়োজন, এত আলো, উদ্বোধন, ছবি, সাজগোজ সবই অনর্থক হয়ে পড়বে। বছরের পর বছর এমন সাদা অংশে হলুদ ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে বই নামিয়ে গেছেন তাঁরা। ফোন করে জানিয়েছেন, বইয়ের জন্য যে মেলা সেখানেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাঁদের, অগত্যা মানচিত্র থেকে বেরিয়ে কাঁধে তুলে আমরাই নিয়ে আসি সেই বই। সাদা আর খাঁকি পোশাকের কিছু পাহাড়াদার উঁকি মারেন সেই ক্রেটের ভিতর। তারপর কীসব যন্ত্রে মেপে সিদ্ধান্ত নেন মেলার জন্য বিপজ্জনক কিনা এইসব বইপত্র। 

মজার বিষয় হল, রঙিন মানচিত্র হাতে মেলায় রোজ হারিয়ে যাচ্ছেন কত লোক... গিল্ড অফিসের মাইকে ঘোষণা হচ্ছে তাঁদের নাম, ঠিকানা, বাড়ির লোকের খবর। আমরা টেবিলে বসে শুনছি সেসব। শুধু এই বিশ্বাসে যে হুগলির সিদ্ধার্থবাবু অথবা গোবরডাঙার শীলা মণ্ডল খুঁজে পেয়ে যাবেন তাঁদের বাড়ির লোককে। যাঁরা এই মানচিত্রেই কোথাও হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বসেছেন রিং রোডের বেদিতে। একটুকরো কাগজের ক্ষমতা দেখলে অবাক হতে হয়। ভালোও লাগে, মেলার এই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মেলায় ফিরে এলে। মানুষ দিকনির্দেশ পাক, খুঁজে পাক পছন্দের বই। এটুকুই তো চাওয়া আমাদের...

সন্ধে আটটা বাজছে, সেন্ট্রাল পার্কের ন’টি গেট দিয়ে হাজার হাজার মানচিত্র ছড়িয়ে পড়ছে তার সাদা অংশের দিকে। সেখানে বাস, অটো, ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। প্যাসেঞ্জারের অপেক্ষায়। আমরা নিশ্চিন্তে রাস্তা পেরোই, দেখি মানচিত্র ঘেঁটে যাচ্ছে, রাজ্য, দেশ, বিদেশ মিলেমিশে যাচ্ছে অক্ষরের এই আয়োজনে। বাইরের সাদা অংশ থেকে উঁকি দিচ্ছে কলেজস্ট্রিট, বছরের পর বছর যাদের মেলায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি নানান অজুহাতে...

চিত্রগ্রাহক – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor