নেপথ্য

বইমেলা থেকে ফিরে ।। পর্ব ১৪

‘ব্যাক্তি ডুবে যায় দলে... মালিকা পরিলে গলে 

প্রতি ফুলে কে-বা মনে রাখে…’

এই প্রত্যেকটি ফুলই আসলে মালার অহংকার। তাদের আলাদা আলাদা চিনে রাখা যতটাই কঠিন, সংঘবদ্ধ পরিচয় ততই সহজ। আজ সেই মালাকে থুড়ি মেলাকে নিয়ে লেখা শেষ পর্ব। নেপথ্য। সেইসব মেঘনাদেরা যাদের চকচকে ছবি ওঠে না, যাদের সই বাড়ি নিয়ে যায় না পাঠক। কেবল কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যারা সওদা করেছে জীবনের, নিজের মর্যাদার। আমরা তাদের কোথাও দেখতে পাই না এই মাঠে। হয়তো আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে। মেলার সাফল্যে আটখানা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাগে ব্যাগে… কখনও সে ভ্যানওলা, কখনও অন্ধ পেন বিক্রেতা, কখনও অবাঙালি ট্যাক্সি ড্রাইভার, পুস্তানিতে আঠা মারা পাটনার তরুণ আবার কখনও দেশ-এবং মুশায়েরা কাঁপানো একসময়ের নামযাদা সাহিত্যিক যাঁকে তাঁর কর্মক্ষেত্র কোনওদিন আসতে দিল না বইমেলায়। 

একটি স্টেজ রিহার্সাল থেকে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার মাঝের সময়ের যে দুশ্চিন্তা তা আমাদের সবার মধ্যেই অল্পবিস্তর থেকে যায় জানুয়ারির এই শেষ সময়ে। কাজ গুটিয়ে আনার তাড়ার মাঝেও ভয় থেকে যায়। বই আসবে তো? যে বই ত্রিশটাও বিক্রি হবে না জানি, তাকে একশো ছেপে বাড়ি ঢোকানোর তাড়ায় কত মানুষের অবেলার ভাত কেড়ে নিয়েছি এতদিন। ইদানীং কেউ কাউকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না আর। প্রেস সময়ের চেয়ে আগে বই দিচ্ছে, প্রকাশক বই পাওয়ামাত্র টাকা মিটিয়ে দিচ্ছেন। দোকানদার বিক্রির টাকা বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসছে প্রকাশকের। লেখক সময়ে পাণ্ডুলিপি দিচ্ছেন। সরকার অবাক… এর ঠিক কিছুক্ষণের মধ্যে বিকট এক শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি কেমন কালোসাদা হয়ে গেছে সবকিছু। আমরা এমন সরলরৈখিক জীবন তো চাইনি। মিথ্যা তাহলে আমাদেরই যাপনকে রঙিন করে তোলে নিঃসন্দেহে…

চরিত্রেরা কমে আসছে নাটকে। গতবার অব্দিও যাঁদের অন্তত দু’দিন দেখেছি মেলায়, তাঁদের অনেকেই এসে পৌঁছালেন না এবার। অনেকেই আর পৌঁছাবেন না কখনও। এই চলে যাওয়া, এই ফিরে না আসা নিছক পছন্দের বই খুঁজে না পাওয়ায় হলে কতই না আনন্দ পেতাম… শীতের দুপুর, কয়েকবছর আগে, টেবিল সাজিয়ে পত্রিকা হাতে রোদ ঢাকছি মুখের, সামনে এসে দাঁড়ালেন ছড়াকার দীপ মুখোপাধ্যায় এবং ঔপন্যাসিক কিন্নর রায়, দুই জ্যেঠু আমার। কেমন আছ জিজ্ঞাসা করতেই আপত্তি জানিয়ে বললেন জ্যেঠু আবার কী… নাম ধরে ডাকবি, দীপ, কিন্নর… হাসিঠাট্টার শেষে একটি ছবি তুলি, দুজনের। পরে খেয়াল করি সেই ছবিতেই এসে গেছেন গৌতম ঘোষ দস্তিদার। গৌতমদা, উর্মিলাদি সেবছর শেষ বসেছিলেন প্যাভেলিয়নে, শারীরিক কারণে বন্ধ করে দিয়েছেন রক্তমাংস। আর দেখা হয় না। ওঁদের কথা মনে পড়ে খুব। দীপ মুখোপাধ্যায় এবার মেলায় নেই। নেই ভাষালিপির নবনীতাদি। ভাষালিপিও স্টলে চলে গেছে প্যাভেলিয়ন ছেড়ে। জানি না এখনও কোনও গ্রামের ছেলে পকেট থেকে ছেঁড়া টাকা বার করে বই কিনতে গেলে তাঁকে বিনামূল্যে দিয়ে দেওয়া হয় কিনা…

রাজা লেন, আমার আরেক ঠিকানা হয়ে উঠেছিল কয়েক বছরে, জন্মদিনে বাড়িতে ঝগড়া হলেও যেখানে গিয়ে পড়ে থাকতাম। প্রবীণদের গল্প শুনতাম, লেখা, প্রকাশনা, বই হয়ে ওঠার গল্প। কখনও নবনীতাদির স্কুলের গল্প। আমফানে যখন ভেসে যাচ্ছে কলেজস্ট্রিট, রাজা লেনের ঘর তখন এক হাঁটু জলে ডোবা। হাজার হাজার বই নষ্ট হয়ে গেছে, জল ঢুকে গেছে একমাত্র কম্পিউটারটির সিপিইউতে। এত ক্ষতির পরও একটি মানুষ মোটা টাকার ত্রাণ পাঠাচ্ছেন, বাকি দোকানগুলির জন্য, যাঁদের এবারটা সামলে না দিলে হয়তো পরিবারসমেত ভেসে যাবে। এমন সব মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি বলেই বোধহয় সাহিত্যের রাজনীতি এখনও গ্রাসে আনতে পারেনি আমাদের। নবনীতাদি আছে, নেপথ্যে আছে আমার। ওর আদর্শ, ওর ভালোমানুষির যদি কিছুটাও রাখতে পারি, বর্তে যাব। 

সন্দীপদা নেই। সন্দীপ দত্তকে ছাড়া একটা গোটা বইমেলা কাটিয়ে ফেললাম আমরা। শার্টের উপর একটি প্রিন্টেড গেঞ্জি, মাথায় টুপি পরে টেবিলের সামনে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি খোঁজ নিতেন বন্ধুদের, খোঁজ নিতেন জয়িতার। নতুন কী কাজ হচ্ছে, কী ভাবছি সবই আলোচনা হত। খামে করে নতুন বইপত্র হাতে গুঁজে দিতাম তাঁর। না কিনে নিতে রাজি হতেন না। এই ধমকাধমকির শেষে রাগে গজগজ করতে করতে হার মেনে নিতেন তিনি। গতবার যখন বই নিয়ে চলে যাচ্ছেন, তখনও জানি না মেলায় ঐ দেখাই শেষ দেখা। সন্দীপদা আমাদের কাছে হেঁটেচলে বেড়ানো লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা ছিলেন। মাথায় একগুচ্ছ তথ্যসূচি নিয়ে তিনিও ছেড়ে গেলেন আমাদের। 

আমার তিরিশ বছরের জীবনে অন্তত গত তেইশ বছরের মেলা আমি মনে করতে পারি। সেই বইমেলা আর এই বইমেলা হয়তো একটাই মেলা বলে মেনে নেওয়া কঠিন হবে। যদি দুভাগে ভাগ করি তবে প্রথম এগারো বছর পাঠক হিসাবে টিকিট কেটে দেখতে ঢুকেছি মেলা। ইনগরেশনেও তখন ছিল না অবাধ প্রবেশ। বাবার কার্ড দেখিয়ে ঢুকতে পারতাম। এটুকু আড়াল উপভোগ করেছি খুব। যেন মলাট খুলে ঢুকতে হচ্ছে বইয়ে। আর শেষ বারো বছর কর্মী হিসাবেই কাটিয়েছি এই মেলা। আর এমন দ্বিচারিতার কারণেই হয়তো বেমানান লাগেনি কখনও। যা রয়ে গেছে তা মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া, কাজের ধরন, দেরিতে বই এসে পৌঁছানো, আর শেষদিনের ঘণ্টার গা শিরশিরানি আওয়াজ। আচমকা সবার হাততালি দিয়ে ওঠা। গায়ে কাঁটা দেওয়া এই মুহূর্তের শেষে সবাই সবাইকে জড়িয়া ধরা। আমাদের বিজয়া দশমী। না কোনো বিসর্জন, না কোনো ঢাকের আওয়াজ। কেবল অস্থায়ী এই আস্তানা ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া, আরেক অস্থায়ী আস্তানায়। তারপর কোনো একদিন স্থায়ী সেই ফিরে যাওয়া, যে প্রস্থানের নেপথ্যে কোনো সুর নেই, কবিতাপাঠ নেই। কেবল কিছুটা শূন্যস্থান, যা ভরাতে উঠে আসে নতুন কেউ… আমাদের বইমেলা জারি থাক সগৌরবে…

চিত্রগ্রাহক – দেবব্রত কর

Powered by Froala Editor