‘মিথ্যে মহামারী’ তৈরি করে ৮ হাজার ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন পোলিশ চিকিৎসক

তিরিশের দশকের শেষের দিক সেটা। পোল্যান্ডের দখল নিয়েছে নাৎসি সেনারা। শুরু হয়ে গেছে ইহুদি-নিধনযজ্ঞ। অত্যাচার, নির্যাতন তো চলছেই; সেইসঙ্গে পোল্যান্ডজুড়ে চলছে ইহুদিদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। বাসস্থান কেড়ে নিয়ে তাঁদের ঠাঁই দেওয়া হচ্ছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। তবে নাৎসিদের এই কর্মকাণ্ডে বাধ সাধল টাইফাসের সংক্রমণ। পোল্যান্ডের কিছু কিছু অংশে পরিস্থিতি এতটাই ঘোরতর হয়ে উঠেছিল যে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছিল ৭৫০। টাইফাসের আতঙ্কেই বেশ খানিকটা ধীর হয়ে গিয়েছিল পুনর্বাসনের গতি। সংক্রমিত এলাকাগুলিতে প্রবেশ করাও বন্ধ করে দিয়েছিল নাৎসিরা।

তবে এই মহামারীকালীন পরিস্থিতিকেই নাৎসিদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করে তুলেছিলেন এক পোলিশ চিকিৎসক। টাইফাস-আতঙ্কের সুযোগ নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন প্রায় আট হাজার মানুষের। বা, বলা ভালো তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন ‘মিথ্যে’ মহামারী (Fake Pandemic)। ঠিক বোধগম্য হল না নিশ্চয়ই? বেশ শুরু থেকেই বলা যাক তবে।

কথা হচ্ছে পোলিশ চিকিৎসক ইউজিন লাজস্কিকে (Eugene Lazowski) নিয়ে। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগের কথা। পোল্যান্ডের ওয়ারশ-এর জোসেফ পাই সুডস্কি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিক্যাল পাশ করেন ইউজিন। জার্মান অধ্যুষিত পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীতে রেড ক্রস বিভাগে চাকরিও জুটল। তবে মন পড়ে থাকত রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকেই। বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন হাজার হাজার পোলিশ নাগরিক। আর তাতে যেন বিন্দুমাত্র যায় আসে না জার্মান প্রশাসনের।

ইহুদিদের চিকিৎসা করার ওপরেও কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল নাৎসিদের। অমান্য করলে মৃত্যুদণ্ড। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ওয়ারশ-র রেলস্টেশনে এবং স্থানীয় ইহুদি ঘেটোগুলিতে গোপনে ওষুধ সরবরাহ শুরু করেন ইউজিন। সেভাবেই সেনাবাহিনীর বাইরেও স্থানীয়দের মধ্যেও বেশ পরিচিতি গড়ে উঠেছিল তাঁর। জার্মান সেনাদের গতিপ্রকৃতি, নজরদারি সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর।

আরও পড়ুন
পেশা নাৎসি-শিকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাস্তব ‘অ্যাভেঞ্জার’-রা

১৯৩৯ সালের শেষের দিকে, ইউজিন এবং তাঁর সহকর্মী ও সহপাঠী স্তানিস্ল মাতুলেউইকস আবিষ্কার করেন এক চমকপ্রদ পন্থা। টাইফাসের টিকা তৈরি করতে গিয়েই একটি অদ্ভুত ঘটনা নজরে আসে তাঁদের। মৃত টাইফাস ব্যাসিলাসকে মানবদেহে প্রয়োগ করলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি আক্রান্ত হন না টাইফাসে। তাঁর থেকে সংক্রমণ ছড়ানোরও ভয় থাকে না। তবে ইনজেকশন দেওয়ার প্রায় দু’মাস পরেও তাঁর রক্তপরীক্ষা করলে পজিটিভ আসে টাইফাসের রিপোর্ট। 

আরও পড়ুন
৭ হাজারেরও বেশি শিশুকে নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় মা’

এই আবিষ্কারই যেন অস্ত্র তুলে দেয় ইউজিনের হাতে। গোপনে শুরু হয় রেজওয়াডোর ইহুদি ঘেটোগুলিতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে মৃত ব্যাসিলাসের টিকাকরণের কাজ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনিই এই অভিযান চালাতেন ‘নিষিদ্ধ’ অঞ্চলে। উল্টোদিকে স্তানিস্ল ল্যাবরেটরিতে তৈরি করতেন মৃত টাইফাস ব্যাসিলাস। অবশ্য এই কর্মকাণ্ডে ভূমিকা ছিল স্থানীয়দেরও। ইউজিনের নির্দেশ মেনে টাইফাস আক্রান্তদের উপসর্গের মতোই অভিনয় করতে হত তাঁদের। দ্বারস্থ হতে হত জার্মান কার্যালয়ে। তারপর রক্তপরীক্ষা। পজিটিভ রিপোর্ট। কোয়ারেন্টাইন।

আরও পড়ুন
জার্মান হয়েও বাঁচিয়েছেন ইহুদিদের প্রাণ, আট দশক পর জুটল স্বীকৃতি

তবে কোয়ারেন্টাইন না বলে, কন্টেনমেন্ট জোন বললেই হয়তো আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সুবিধা হবে সেদিনের অবস্থাটা। একের পর এক টাইফাসের রিপোর্ট এলেই কন্টেনমেন্ট জোন থেকে তড়িঘড়ি সেনা সরিয়ে নিতে জার্মানি। বিচ্ছিন্ন করে রাখা হত সংশ্লিষ্ট লোকালয়টিকে। সেই সুযোগেই চলত ‘পাচার’। গোপনে ইহুদিদের দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতেন ইউজিন।

বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে এসে রাশিয়ান বাহিনীর কাছে ধরা পড়েছিলেন ইউজিন। ছাড়া পেলেও নিস্তার মেলেনি। নাৎসি সেনাদের সঙ্গেই যে বন্দি হয়েছিলেন তিনি। ফলত, দেশের চোখে ‘শত্রু’ হিসাবেই বিবেচিত হয়েছিলেন ইউজিন। আশ্রয় নিতে হয় আমেরিকায়। পরবর্তীকালে ষাটের দশকে দেশে ফেরেন তিনি। প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘প্রাইভেট ওয়ার’ নামে একটি আত্মজীবনী। সেই বই প্রকাশের পরই সামনে আসে তাঁর গল্প। ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করতে টেস্টিমোনিয়ালও হয় পোল্যান্ডে। না, দেশ-বিদেশের উপকৃতরা চিনতে ভুল করেননি তাঁদের এককালীন রক্ষাকর্তা, এই পোলিশ চিকিৎসককে। শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালে হলোকাস্ট হিরোর সম্মান জোটে তাঁর কপালে। শুধু সাহসিকতা কিংবা মানবিকতাই নয়, তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং উদ্ভাবনীও সমানভাবেই প্রশংসনীয়… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More