জার্মান হয়েও বাঁচিয়েছেন ইহুদিদের প্রাণ, আট দশক পর জুটল স্বীকৃতি

১৯৩৩ সাল। চ্যান্সেলরের ক্ষমতায় আসার পর পরই ‘ডিক্টেটর’ হয়ে ওঠেন হিটলার। নিষিদ্ধ করেন বিরোধী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে। ইহুদি-বিদ্বেষ বপনের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন থেকেই। সেই অস্থির সময়ে নিউকোলন সিটি কাউন্সিল থেকে কাজ হারিয়েছিলেন তিনি। না, কোনো দলীয় সংগঠন নয়। বরং, এককভাবেই ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছিলেন নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে। প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন নিপীড়িত ইহুদিদের নতুন জীবনদানের। ম্যাক্স শিন্ডলার (Max Schindler)। এবার তাঁর বীরত্ব, সততাকে বিশেষ সম্মাননা জানাল জার্মান প্রশাসন। স্বীকৃতি দিল প্রায় আট দশক আগের ইতিহাসকে।

ম্যাক্স এবং ম্যালউইন শিন্ডলার (Schindler Couple)। হিটলার প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে নিজ-বাড়িতে ইহুদিদের (Jews) আশ্রয়প্রদান তো বটেই, আরও বহু মানুষকে জার্মানি ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন এই জার্মান দম্পতি। হিটলার ক্ষমতায় আসার পর ইউরোপের রাজনৈতিক আবহাওয়াকে ভালোভাবেই অনুমান করতে পেরেছিলেন ম্যাক্স। বুঝে গিয়েছিলেন পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়ার মতো জার্মানির প্রতিবেশী দেশগুলি খুব দ্রুতই জোটবদ্ধ হতে চলেছে হিটলারের সঙ্গে। আর তা যদি না হয়, তবে যুদ্ধের মাধ্যমে দখলদারি নিতে পিছপা হবেন না হিটলার। ফলে, জার্মানি থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে গেলে ইহুদিদের আশ্রয় নিতে হবে ব্রিটেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে। আর তার জন্য প্রয়োজন ইংরাজির জ্ঞান। 

হিটলারের আগ্রাসন থেকে ইহুদিদের বাঁচাতে সেই জায়গাটাকেই হাতিয়ার করে নেন ম্যাক্স। ইতিপূর্বে প্রশাসনিক কাজ করার জন্য ইংরাজি ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল আগে থেকেই। হিটলার ক্ষমতায় আসার পর তিনি শুরু করলেন ইংরাজি শিক্ষাদানের প্রতিষ্ঠান। তবে তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। শিক্ষাদানের ছল করেই সেসময় তিনি হাজির হতেন ইহুদি এবং রাজনৈতিক সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বাড়িতে। একদিকে যেমন চলত শিক্ষাদান প্রক্রিয়া, তেমনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে তাঁদের আইনত অভিবাসনের সুযোগ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন তিনি। 

বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর, খোদ বার্লিন শহরেও শুরু হয়ে যায় ইহুদি নিধনযজ্ঞ। গেস্টাপোর নজর এড়িয়ে সেইসময় ঝুঁকি নিয়েই নিজের বার্লিনের বাড়িতে তিনি আশ্রয় দেওয়া শুরু করেন ইহুদিদের। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর বেসমেন্টেই বসবাস করত বেশ কয়েকটি ইহুদি পরিবার। খাবার থেকে শুরু করে জীবনযাপনের সমস্ত রসই তাঁদের হাতে তুলে দিতেন ম্যাক্স-ম্যালউইন। কিন্তু ঠিক কতজন তাঁদের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছিলেন, আজও স্পষ্ট নয় সেই সংখ্যাটা।

আরও পড়ুন
নাৎসিদের হাতে লুঠ হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধে, নিলামে ভ্যান গঘের আঁকা সেই ছবিই

তবে ইহুদিদের ত্রাতা হয়ে উঠলেও, বিশ্বযুদ্ধের পর চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়তে হয়েছিল শিন্ডলার দম্পতিকে। ১৯৪৮ সালেই মারা যান ম্যাক্স। রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে তাঁকে কোথায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল, সেটাও অজ্ঞাত আজ। ম্যালউইন বেঁচে ছিলেন আরও দু’দশক। ১৯৬৩ সালে তাঁকে ‘আনসাং হিরো’-র সম্মাননা জানানো হলেও কোনোরকম স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়নি। ফলত, ইতিহাসের পাতা থেকে মুছেই গিয়েছিল শিন্ডলার দম্পতির এই বীরত্বের কাহিনি।

আরও পড়ুন
সংগ্রহে ৮ হাজার নাৎসি প্রত্নসামগ্রী! অপরাধী ধরতে গিয়ে হতবাক পুলিশ

বছর দুয়েক আগে ট্রাঙ্কবন্দি অবস্থায় বেশ কিছু চিঠি এবং ছবি খুঁজে পান অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার বাসিন্দা ফ্রান্সেস নোয়েল। এই চিঠিসমূহের লেখক স্বয়ং তাঁর দাদু। হ্যাঁ, তিনিও বিশ্বযুদ্ধের সময় আশ্রয় পেয়েছিলেন শিন্ডলার দম্পতির বাড়িতে। সেই চিঠির দৌলতেই ফের সামনে আসে ম্যাক্স-ম্যালউইনের গল্প। সম্প্রতি ফ্রান্সেসের আবেদনই পুনরায় শিন্ডলার দম্পতিকে হলোকাস্ট-হিরোর সম্মাননা জানাল জার্মান সরকার। বার্লিনে শিন্ডলার দম্পতির বাড়ির সামনে বসল বিশেষ ফলকও। ম্যাক্স-ম্যালউইনের গল্প সামনে এল ঠিকই, আট দশক পরে হলেও যোগ্য সম্মাননা মিলল তাঁদের। কিন্তু ম্যাক্সের মতো আরও বহু নায়ক আজও রয়ে গেছেন বিস্মৃতির আড়ালেই…

আরও পড়ুন
প্রকাশ্যে ঝুলছে অপরাধীর মৃতদেহ, তালিবানদের নৃশংসতায় নাৎসি-ছায়া

Powered by Froala Editor