৪০০ পেরিয়েও আজও সচল ভারতের প্রাচীনতম ‘জীবিত’ গ্রন্থাগার

তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুর শহর। এই শহরের দাঁড়িয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক মারাঠা প্যালেস। ১৫৩৫ সাল থেকে ১৬৭৪ সাল পর্যন্ত এই প্রাসাদ থেকেই শাসনকার্য চালাতেন ‘নায়ক’ রাজবংশের রাজারা। তৎকালীন সময়ে যাঁরা রুখে দিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতে বৈদেশিক আক্রমণও। তবে শুধু সামরিক দিক থেকেই নয়, নায়ক রাজাদের শাসনকালে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিল থাঞ্জাভুর। এমনকি প্রাচীন সাহিত্য সংরক্ষণের জন্য তৈরি হয়েছিল বিশেষ এক লাইব্রেরি। যা তামিলনাড়ুর (Tamil Nadu) প্রাচীনতম গ্রন্থাগার তো বটেই, ভারতের প্রাচীনতম ‘জীবিত’ গ্রন্থাগার।

সরস্বতী মহল লাইব্রেরি (Sarasvati Mahal Library)। স্থানীয়দের কাছে ‘মহারাজা সেরফোজির লাইব্রেরি’ হিসাবেও পরিচিত এই গ্রন্থাগার। মজার বিষয় হল, সেরফোজি আদতে নায়ক রাজবংশের কোনো শাসক নন। তিনি মারাঠা। প্রশ্ন ওঠে, নায়ক রাজারা গ্রন্থাগারের নির্মাতা হওয়া সত্ত্বেও এক মারাঠা রাজার নামে কেন পরিচিত এই লাইব্রেরি? 

খুলেই বলা যাক বিষয়টা। ১৬৭৫ সালে তাঞ্জোর বা বর্তমান থাঞ্জাভুর আক্রমণ করেন মারাঠা সম্রাট। সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেননি নায়করা। অবশ্য তাঞ্জোরের ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলেও, থেমে থাকেনি সাহিত্য সংরক্ষণের কাজ। বরং এই লাইব্রেরিকে সাজিয়ে তুলতে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন মারাঠা মহারাজ সেরফোজি দ্বিতীয়। দূরদর্শী শাসক হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন দার্শনিক, মানবতাবাদী এবং সংস্কৃত পণ্ডিত। সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। থাঞ্জাভুর লাইব্রেরিতে যে-সকল প্রাচীন গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল, সে-সব কিছু দিনের মধ্যেই পড়ে ফেলেন সেরফোজি। তারপর বই-খিদে মেটাতে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আমন্ত্রণ জানান সংস্কৃত পণ্ডিতদের। 

তাঁদের থেকে শুধু অর্থের বিনিময়ে গ্রন্থ সংগ্রহই নয়, বহু প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের অনুলিপিও তৈরি করিয়েছিলেন সেরফোজি। সংস্কৃত ছাড়াও ছিল তামিল, তেলেগু মারাঠি ও ইংরাজি গ্রন্থও। তাছাড়া সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, তিনি তৈরি করিয়েছিলেন ভারতের সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্য-ধর্মী মানচিত্র। যা রীতিমতো অবাক করার মতোই। মজার বিষয় হল, সতেরো শতকের শেষের দিকে এই লাইব্রেরিতেই মুদ্রিত হয়েছিল বিশ্বের প্রাচীনতম অ্যাটলাস এবং প্রাচীনতম তামিল বাইবেল। যা ২০০৫ সালে চুরি যায় এই লাইব্রেরি থেকে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর এই বাইবেলটির সন্ধান পাওয়া যায় লন্ডন মিউজিয়াম থেকে। 

যদিও বয়সের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, নায়কদের শাসনকালের বহু আগে থেকেই ভারতের বুকে নির্মিত হয়েছিল একাধিক লাইব্রেরি। তবে সে-সব হারিয়ে গেছে কালের আবহেই। অথচ, ৫০০ বছর পেরিয়েও আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে নায়ক রাজাদের এই অপার্থিব সৃষ্টি। আজ এই লাইব্রেরিতে পাণ্ডুলিপির সংখ্যা প্রায় ৪৯ হাজার। যার মধ্যে রয়েছে শুধু ৩৯ হাজার সংস্কৃত গ্রন্থ। সাড়ে ৩ হাজার তামিল এবং ৩ হাজার মারাঠা সাহিত্যের দুর্মূল্য গ্রন্থও রয়েছে এই গ্রন্থাগারে। যাদের মধ্যে উল্লেখ্য, শ্রী রামদাস ও দত্তাত্রেয়ের পাণ্ডুলিপির প্রাচীনতম সংস্করণ। রয়েছে ১৮০৭ সালে মুদ্রিত মাদ্রাজ অ্যালমানক, সেরফোজি দ্বিতীয়র প্রচলন করা নোট, সেরফোজির ব্যবহৃত গ্লোব, মানচিত্র, চিঠিপত্র এবং তাঞ্জোর শহরের নকশা পরিকল্পনার একাধিক প্রাচীন নথি। 

অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ শাসনকালে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই লাইব্রেরির দরজা। অবশ্য পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে এই গ্রন্থাগার জনসাধারণের জন্য খুলে দেয় ব্রিটিশ শাসকরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই গ্রন্থাগার তো বটেই, সমগ্র মারাঠা প্যালেসের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় ভারত সরকার। আসলে এই প্রাচীন ‘আর্কাইভ’ শুধু তামিলনাড়ুই নয়, গোটা দেশেরই এক গর্বের জায়গা…

Powered by Froala Editor