প্রয়াত চিত্রগ্রাহক সৌম্যেন্দু রায়, সমাপ্তি ঘটল বাংলা চলচ্চিত্রের একটি অধ্যায়ের

সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) সিনেমার কথা উঠলেই, নিশ্চিতভাবে উঠে আসবে আরো দু’জন কিংবদন্তির নাম। তাঁরা হলেন সুব্রত মিত্র ও সৌম্যেন্দু রায় (Soumendu Roy)। সত্যজিতের প্রথম দিকের কয়েকটি সিনেমার চিত্রগ্রাহকের দায়িত্বে ছিলেন সুব্রত মিত্র। ‘পথের পাঁচালী’-র সূত্রেই সৌম্যেন্দু রায় জড়িয়ে পড়েন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। পরবর্তীতে স্বাধীনভাবে চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রের সৌজন্যে। শুরু হয় পথচলা। তারপর থেকে কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাসহ আরো অসংখ্য চলচ্চিত্রে। একাধিকবার মিলেছে জাতীয় পুরস্কার। অবশেষে ক্যামেরার মায়াবী স্পর্শে দর্শকদের মুগ্ধতাকে সঙ্গী করেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সৌম্যেন্দু রায়। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত সমস্যায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল একানব্বই বছর। 

তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়। ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী। একই সঙ্গে ভালোবাসা জন্মায় ক্যামেরার প্রতি। উপহার পাওয়া ক্যামেরা নিয়ে নানারকম পরীক্ষায় মেতে থাকতেন দীর্ঘসময়। ক্রমে যাতায়াত শুরু করেন টলিপাড়াতেও, আলাপ হয় বর্ষীয়ান চিত্রগ্রাহক রামানন্দ দাশগুপ্তের সঙ্গে। ১৯৫৫ সালে বাংলা সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে বাঁকবদল ঘটল তাঁর জীবনেরও। ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমার সহকারী কলাকুশলীর দায়িত্বে থাকাকালীন পান সত্যজিৎ রায়, সুব্রত মিত্র ও বংশী চন্দ্রগুপ্তের সাহচর্য। প্রায় সকলেই সেই সিনেমায় নবাগত। তবু তার মধ্যেই পেয়েছিলেন অভিনবত্বের স্বাদ। সেই সান্নিধ্য তাঁকে ভবিষ্যতে সাহায্য করেছিল একজন সার্থক সিনেম্যাটোগ্রাফার হয়ে উঠতে। এরপর সত্যজিতের অন্যান্য ছবিগুলিতেও পালন করেন সহকারী চিত্রপরিচালকের দায়িত্ব। ১৯৬১-তে চোখের সমস্যার কারণে সুব্রত মিত্র কাজ থেকে সরে এলে ‘তিনকন্যা’-র সম্পূর্ণ চিত্রগ্রহণের ভার এসে পড়ে তাঁর উপর।

‘তিনকন্যা’-র তিনটি আলাদা গল্পে আলো ব্যবহারের পরিকল্পনা দেখলেই মেলে তাঁর মুনশিয়ানার পরিচয়। এরপর একে একে ‘অভিযান’, ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে ছাপ রেখেন নিজস্ব প্রতিভার। প্রতিটি সিনেমার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন স্বতন্ত্র পদ্ধতি। সীমিত সামর্থ্য, যান্ত্রিক কলাকৌশলও তত উন্নত নয়। এই সব প্রতিবন্ধকতা নিয়েও আলোছায়ার জাদুখেলায় ধরে রেখেছেন সিনেমার আত্মাকে। ‘অশনি সংকেত’ সিনেমার জন্য প্রথমবার অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান। এরপর ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’-র জন্য আরো দু’বার জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে শেষবার কাজ করেন ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে।

সত্যজিৎ রায় ছাড়াও তপন সিনহার তিনটি ছবিতে চিত্রগ্রহণের কাজ করেন সৌম্যেন্দু রায়। তরুণ মজুমদার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ছবিতেও রয়েছে তাঁর ক্যামেরার কাজ। বাংলা ছবির বাইরে ১৯৮২ সালে তামিল পরিচালক শ্রীধর রাজনের ছবিতে চিত্রগ্রহণের জন্য তামিলনাড়ুর স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডের সম্মানেও ভূষিত হন। এছাড়া বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্রেও সিনেম্যাটোগ্রাফারের দায়িত্বপালন করেন তিনি। যার মধ্যে ১৯৯৩ সালে রাজা সেনের ‘সুচিত্রা মিত্র’ তথ্যচিত্রের জন্য ‘নন-ফিচার’ সিনেমার শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহকের খেতাব অর্জন করেন। তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে ‘প্রোর্ট্রেট অফ এ সিনেম্যাটোগ্রাফার’ এবং ‘সৌম্যেন্দু রায়’ নামের দুটি তথ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রকের ‘রূপকলা কেন্দ্র’-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন দীর্ঘসময়। 

গত কয়েক বছরে সিনেমার সঙ্গে যুক্ত বহু গুণী মানুষের মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে বাঙালি। যেন শেষ হয়ে আসছে একটা যুগ। সাদাকালো সিনেমার পর্দায় যাঁরা ফুটিয়ে তুলতেন রঙিন স্বপ্নের স্পর্শ।  সোম্যেন্দু রায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর প্রয়াণে বাঙালি হারাল আরেক কিংবদন্তিকে...

Powered by Froala Editor