উদ্বায়ী

বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ৯


টেবিলের এপাশে যাঁরা থাকেন, কিছু শব্দ তাদের সঙ্গ ছাড়ে না। ‘একটু আসছি’, এ-বছরের মিউজিকাল চেয়ারের দায়িত্বে এসেছে অরিন। অরিন চক্রবর্তী। কবিতা লেখে। যখন অকূল পাথারে, কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না টেবিল সামলানোর, আচমকা ওর ফোন, এ আবির্ভাব আমার কাছে অঘটনের চেয়ে কিছু কম নয়। জানায়, দাদা আমি থাকব, আমার তাহলে বইপত্র কেনার টাকাটা হয়ে যায়... এসব শুনে, না বলি কীভাবে। দু’ফুট বাই তিনফুটের এই আস্তানা ও আগলে নেয় কনিষ্ঠতম সন্তানের মতো, হাসে, গল্প করে আবার কখনও প্রশ্ন করে বসে আমাকেই... উত্তর পায় না

মিউজিকাল চেয়ারে ওকে বসিয়ে এগিয়ে যাই গুহার ভিতর, মেলার উড়তি লোক যে গুহায় ঢোকেনি কখনও। যেখানে চারটে অকেজো চাকায় দাঁড়ানো এক ভ্যান, আর তার পিছনের ঝুপড়ি ঘর থেকে ভেসে আসে খমক। লাগোয়া লম্বা কলতলায় স্নানের শব্দ। শীতের ভরসন্ধ্যায় যে স্নান করতে পারে খোলা আকাশের নীচে, বাংলা কবিতা তার কাছে জলভাত। গুহার মাথায় পুলিশের নাম আঁকা বেলুন, যা দিয়ে জায়গা চেনাই আমরা। আমাদের এই একান্ত গোপন চাঁদ বিকেল গড়িয়ে সরে আসতে থাকে পশ্চিম থেকে পূর্বে, আর পূর্ববর্তী আলোচনায় ভেসে ওঠে হতাশার রেওয়াজ। মেলা আর আগের মতো নেই... মাসের শেষ নাকি আবহাওয়া? উত্তর পাওয়া যায় না... কবি থেকে প্রকাশক, পাঠক থেকে চা-ওলা মিলেমিশে যান একই আলোচনায়, মেলার এই হাল কেন? সাতদিন কাটে, আটদিন কেটে যায়, ছুঁয়ে ওঠা যায় না গতবারের প্রথম তিনদিনকেও। এই হতাশা বাড়তে থাকে ক্রমশ, তারপর কয়েকটি লোক দড়ি টেনে নামিয়ে আনে চাঁদ, তাতে হিলিয়াম ভরে আবার ওড়ায় পরেরদিন, সন্ধ্যে নামার একটু আগে...

স্তব্ধ চারিদিক। আমার বিশ্বাস এই মনখারাপ কেবল বিক্রির নয়, আমার বিশ্বাস বিক্রি ফিরে আসতে বাধ্য। তবে কিছু একটা বস্তু বারংবার নেই, যা হয়তো ফিরেও আসবে না আর। কী নেই? কী নেই এই বৃহত্তম আয়োজনে? সেই ফ্যালফ্যালে চোখ? অসময়ে টেবিলে এসে ভিড়ের চেয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা? সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যেবেলা কাউকে কিছু না বলে একমনে বাঁশের খুঁটিতে আংটি ঘষতে থাকা ছেলেটি? হয়তো তাই। হয়তো ওর নিঃশব্দ অনুপস্থিতিই গলা টিপে মারছে এই বইমেলাকে। জীবন থেকে একটা বছর মুছতে পারলে গতবছরের মেলা শেষে ওকে গাড়িতে ডেকে নিতাম আমি। হয়তো এটুকুই, এলোমেলো হয়ে যেত সমস্ত পরিকল্পনা... হয়তো এবারও চুপচাপ এসে দাঁড়াত ছবিতে। আনন্দের ছবিতেও মায়া হত ওর চেয়ে থাকা দেখে। 

২০২২ সালে যখন শুরু করছি এ-লেখা, গুড্ডু সে-বছর বইমেলায় কিছু ছবি তুলেছিল। অধিকাংশই আনপ্ল্যানড, দুর্দান্ত সব ছবি, যে সিরিজে ধরা ছিল আমাদের এই ছন্নছাড়া অস্থায়ী সংসার। এমনই এক ছবিতে তন্ময়কে জড়িয়ে কাঁদছে অন্তর। অন্তর বা তন্ময় কেউই জানে না ছবির পিছনে তাকিয়ে থাকা অরিত্র সোম কিছুদিন পরই রিক্রিয়েট করাবে এই দৃশ্য। কেবল দ্বিতীয়বার ছবিতে থাকবে না ও। বাচ্চা আমাদের ভালোবাসত, হয়তো পছন্দ করত না। বইমেলা ভালোবাসত কিন্তু উদ্‌যাপন নয়। যেকোনও আনন্দের এপিসেন্টারে থেকে মুহূর্তে গম্ভীর করে দিত পরিস্থিতি। ওর সঙ্গে কেউ একা হতে চাইত না। বন্ধুরাও তাই পালাল শেষমেশ। শুধু ও রয়ে গেল। মায়ের অন্ধত্বে, বাবার অসুস্থতায়, আমাদের হতাশায় রয়ে গেল স্থির। বাকিজীবন আমরা পালাব ওর থেকে। ছাব্বিশ বছরের অরিত্র রয়ে যাবে, রয়ে যাবে ওর সৃষ্টি ওর বিরক্তি ওর অস্থিরতা নিয়ে আমাদেরই মাঝে। রাত দশটায় কেউ মিটিং-এ ডাকবে না, ছুটি দেয়নি বলে বিরক্ত হবে না কারুর উপর।

কাঁদতে কাঁদতে কাকিমা একটা খাম বাড়িয়ে দেয়, গতবছর মেলায় কেনা বই। তাতে আমার হাতের লেখায় বিল, তন্ময়ের বই, অর্ঘ্যর বই, অভিষেকের বই আর আমার। খুলেও দেখেনি সেসব। মৃত্যুর পরিকল্পনা করে ফেলেছিল হয়তো। তবু মেলায় এসেছে। বই কিনেছে, শেষদিনের ঘণ্টা শুনে কেঁদেছে... তারপর অনেক রাত্রে ট্রেনে বাসে বাড়ি ফিরে বলেছে আমাদের সঙ্গে খেয়ে ফিরেছে রাতের খাবার। যে দাদারা বাসস্ট্যান্ডে ফেলে এসেছিল, তাদের বাঁচিয়ে অপরাধী করে গেছে। 

অরিত্রকে নিয়ে এখন অঢেল আলোচনা। ওর লাইন, ওর লেখা, ওর কাজ, দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষের অবর্তমানে কীভাবে তার সব ভুল মুছে যায় হয়তো জানতে পেরেছিল ও। ওর বই খুঁজে কিনতে আসছেন অনেকে। অরিত্রর শেষ কবিতার বই। যাঁরা চেনেন, যাঁরা চেনেন না... জীবনের মূল্যে নিজের মর্যাদা অর্জন করেছে ও, তাই কি এত লিখেছিল গোপনে? কাউকে না পড়িয়ে, কোথাও না পাঠিয়ে? 

আমাদের মন ভালো নেই। এ বোঝা বাকিজীবনের তাই হাসিমুখে তুলে নিয়েছি কাঁধে। এখন আমার দুটো সংসার। গুহা থেকে বেরিয়ে আসি লিকার চায়ের দাম মিটিয়ে। গত একবছরে অনেকখানি বয়স বেড়ে গেছে। অরিনের ফোন ‘দাদা টেবিলে এসো, অরিত্রদার দিদি এসেছেন, তোমাদের দেখতে চাইছেন...’। একজন সাধারণ চেহারার মধ্যবয়স্কা মানুষ, ওর বই হাতে নিয়ে কাঁদছেন টেবিলে। আরেক হাতে রুমাল। দু’আঙুলে সেই রুমাল সামলে আমার অনুর্বর গাল কাঁচিয়ে আদর করেন। মনে হয় শাস্তি মকুব হল, বই গুছিয়ে মাঠ ছাড়ব এবার। ময়লা গাড়ির জলে ভিজে যাচ্ছে কাকিমার আঁচল। 

‘আকাশ ও কি ফিরে গেছে? জানো?’

...


 

 চিত্রগ্রাহক - অর্ণব বসু

Powered by Froala Editor