জলবায়ু

বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ১০


জল ছিটে এল যেন কোথা থেকে, আজ তো পূর্বাভাস নেই... রোদ দেখেও মনে হয়নি তেমন কোনো সম্ভাবনা আছে। খানিকক্ষণের তল্লাশি শেষে তাই জানা গেল অপরাধী আসলে জলের পাউচ। বইমেলার অদ্ভুততম চরিত্র। অস্বাভাবিক এই বস্তুটির উপস্থিতি নাজেহাল করে, অথচ অনুপস্থিতিও খুব সুখকর নয়। যাঁদের মাঠেই কাটে সারাটাদিন, এই অনিবার্য অস্বস্তি তাদের বয়ে নিয়ে যেতে হবে বাকিজীবন। ঠিক কবে ও কীভাবে বইমেলায় এসে ঢোকে এই জলের পাউচ তা আর মনে পড়ে না। কোনও এক নির্মল দিনে কেউ একজন নিশ্চয় আবিষ্কার করেছিলেন জলকে পাউচে ভরে এভাবে হেনস্থা করা যায় মানুষকে...

সাধারণ হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারির শেষ বুধবারে শুরু হয়ে থাকে মেলা, নানান আস্তানা ঘুরে করুণাময়ীতে থিতু হওয়া এই মেলার অর্ধেকটা ভিজে থাকে পাউচের জলেই। কেবল দেশ কেন, এই পাউচ হাতে নির্দ্বিধায় মানুষ ঢুকে পড়েন বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ইউএসের মতো জায়গায়। একটি নোংরা দেখতে স্বচ্ছ প্লাস্টিক, তার গায়ে নীল অক্ষরে কী যেন লেখা যা আজ অব্দি কেউ পড়েছেন বলে বিশ্বাস নয় আমার। মেলার সত্তর শতাংশ লোক জানেন এটা খেলেই পেট খারাপ হবে। বাকি তিরিশ শতাংশ গোটা পশ্চিমবঙ্গ থেকে জড়ো হওয়া সেইসব প্রতিভাবান মানুষ যাঁরা এই জলকে নানান কাজে ব্যবহার করে থাকেন। শাড়িতে পড়া চা পরিষ্কার, টিফিনের পর হাত ধোয়া, মাঠের ধুলো কমাতে ঢেলে দেওয়া, ব্যাথা লাগার পর বরফের বদলে রগড়ান, পটি করে ফেলা শিশুকে সামলে তোলা, লিকার চা বানানো, ঘ্যানঘ্যানে বন্ধুর গায়ে ঢেলে দেওয়া ইত্যাদি। এর বাইরে কেবল আমি, তন্ময় আর মুড়ি বেচতে আসা কাকু যারা এই জল ভরসা করে খেয়ে যাচ্ছি প্রতিবছর। বিশেষ দ্রষ্টব্যে জানিয়ে রাখা ভালো, পেট খারাপ ঘটিয়ে তন্ময়ও প্রথম ৭০ শতাংশে নাম লিখিয়েছে এবছর। তবে এসবের থেকে আরেক কাঠি উপরে থাকেন প্যাভেলিয়নের কিছু লিটল ম্যাগাজিন, বছর দুয়েক এবং বছর ছয়েক আগে দুবার দুই প্রতিবেশী পত্রিকা ছোট্ট কথা-কাটাকাটির উত্তরে বাড়ি যাওয়ার সময় ছেঁড়া জলের প্যাকেট রেখে যান আমাদের বইয়ের ব্যাগের উপর। এ প্রতিভা নিঃসন্দেহে বিরলতম। 

একটি মেয়ে সদ্য চুল খুলে দাঁড়িয়েছে রাস্তায়, ভিড়ের মধ্যে থাকা প্রেমিকারা বুঝতে পারছে প্রেমিকের অন্যমনস্কতা। একদিকে লিটল ম্যাগাজিন, একদিন পঞ্চাশের স্টল, পিছনে ভিড় নিয়ে তাঁর ছবি তুলে দিচ্ছে তরুণ ছেলেটি। আচমকা দুম শব্দে পাউচ ফেটে ছিটে এল বৃষ্টির ঝাঁপ। পুলিশের গাড়ি। হেসে ওঠে ছেলেমেয়েদুটি। শীতের এই অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি যেন প্রেমের সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো রোমান্টিক এই বয়সে... 

কত গল্প ডুবে এই জলে। অর্ণবকে জল আনতে পাঠালে ঘণ্টা দু’তিনেক ওকে পাওয়া যেত না আর। তারপর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানাতে হত, কেউ না কেউ মনে করিয়ে দিত ওকে তৃষ্ণার্ত বন্ধুর কথা। যখন ফিরে আসত, না মেলায় কোনো সুন্দরী যুবতী টিকে থাকতেন, না টিকে থাকত আমার তৃষ্ণা। ব্যাগ গুছিয়ে হাতে পাউচ নিয়ে আমরা হাঁটতে থাকতাম ৯ নম্বরের দিকে। আমি তন্ময়ের চটি চেপে ধরতাম পিছন থেকে। সুপ্রিয় একটা পাউচ আকাশের দিকে তুলে তাতে অল্প অল্প চাপ দিয়ে বৃষ্টি নামাত, আর পুলিশ বেরোনোর তাড়া দিলে চিৎকার করে বলত ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?’

সুপ্রিয় তেমন এল না মেলায় এবার। তাই হয়তো বৃষ্টি হল। তিনদিন। কলকাতাবাসী ছাতা হাতে ঘুরে দেখল বইমেলা... সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। শীতের দার্জিলিং এর মতো ছাতায় ছাতায় ছেয়ে গেছে রিং রোড। মেট্রো স্টেশনের আলো মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো ছড়িয়ে যাচ্ছে নানান দিকে। কেউ তার মুণ্ড পাচ্ছে, কেউ হাত, কেউ অন্য কোনও প্রত্যঙ্গ প্যাকেটের গায়ে নিয়ে উঠে পড়ছে সাউথের বাসে। বৃষ্টি থেকে বই বাঁচাচ্ছে প্রকাশক, যাঁদের ছাতা নেই, ঢুকে আসছেন প্যাভেলিয়নে। চোখ চিকমিক করে উঠছে দেখে, অচেনা অজানা কত মানুষকে ঠাঁই দিচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন। সূচিপত্রের মতো তাঁরা স্পেস খুঁজে নিচ্ছে, অপেক্ষা করছে পাতা শুকোবার। 

মাথায় রুমাল চেপে দৌড়ে যাই গুহার দিকে, ভ্যানে প্যাকেট চাপা দিয়ে চা বিক্রি হচ্ছে আজ। কেবল আজকেই চা এক নিষিদ্ধ মাদক। ঘর থেকে সামান্য বেরিয়ে থাকা চালের নীচে অর্ধেক আশ্রয় পাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের প্রচ্ছদ ভিজে যাচ্ছে, শুকনো থাকছে ব্যাককভার। কাঁধের জল হাত হয়ে নেমে আসছে আঙুলে, ভিজে যাচ্ছে ফিল্টার আর শেষ টানের সন্ধিক্ষণ। মেলা ফাঁকা হচ্ছে, বৃষ্টি থামলে কেউ থাকবে না আর। হাঁটতে থাকি টেবিলের দিকে, কে যেন চড়া গলায় ডাকে, ‘বিক্রি কেমন?’ হাতে জলের পাউচ, আধখানা খেয়ে চোখ নামিয়ে দেখি সুদীপ্তদা, মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই, উত্তর দিই মন্দের ভালো... গাছের আড়ালে বোতলে পাউচ খালি করে তারপর যত্নে, সে পাউচ গুঁজে রাখছে জানলার গ্রিলে। যে জানলার ঘষা কাচে কাউকে অপ্রস্তুত দেখে ফেলে গলা ভিজে গিয়েছিল গতবছর। 

চিত্রগ্রাহক – অরিত্র দত্ত

Powered by Froala Editor