হেমন্ত-সন্ধ্যা— বাংলা গানের কিংবদন্তি জুটির নেপথ্যকথন : ১

'সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে একজন ভালো গায়িকা। তবে, ওর আর একটা বড়ো পরিচয় হল, সন্ধ্যা একজন সুন্দর চরিত্রের মেয়ে।' জীবন-সায়াহ্নের বাংলাদেশ সফরে গীতশ্রীর সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছিলেন সর্বশ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukhopadhyay)।

মৃত্যু জগতের এক চিরন্তন সত্য। বাঙালীর গর্ব 'মহাগায়িকা' সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (Sandhya Mukhopadhyay) সুরলোকের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন নবতিপর হয়েই। এই বয়সে ওঁর চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক হলেও তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন 'বাংলার স্বর্ণযুগ' বিদায় নিল সম্পূর্ণরূপে— এ কথা স্বীকার করতেই হবে। আর এই শূন্যতা আর পূর্ণ হবার নয়। পর্দায় 'মহানায়ক' উত্তমকুমারের সাথে 'মহানায়িকা' সুচিত্রা সেনের রোম্যান্টিক জুটি যেমন বাঙালির রক্তে মিশে গেছে, ঠিক তেমনই পর্দার আড়ালের 'উত্তম-সুচিত্রা' হলেন হেমন্ত-সন্ধ্যা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণে বাঙালিকে প্রথম সরাসরি 'ফিল্মি-রোম্যান্সের' স্বাদ দেওয়ার কান্ডারীরা যেন চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। শুধু প্রমান করে দিয়ে গেলেন যে, বাঙালি জাতির চিরকালীন মূল সুর কিন্তু 'প্রেম'।

পর্দার এবং পর্দার বাইরেও 'উত্তম-সুচিত্রা' জুটির রসায়ন যেমন বাঙালির চায়ের আড্ডার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ঠিক তেমনই 'হেমন্ত-সন্ধ্যা' জুটির সম্পর্কেও বাঙালি সম্পূর্ণ উদাসীন নয়। এঁদের দুজনের সম্পর্কেও নানা সময় নানা আলোচনা একটু কান পাতলেই কিন্তু শোনা যায়। তার কোনোটি সত্য, কোনোটি হয়ত শুধুই রটনা। ঠিক কেমন ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক— এ নিয়ে বাঙালির কৌতূহল কম নয়, তবে একটি গোটা অথবা মোটামুটি সম্পূর্ণ আলোচনা আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। ঈশ্বরপ্রতিম শিল্পীদের অমায়িকতার তুলনা তো আজ আর মেলে না, তাই এখানে আমাদেরও অনেক কিছু শেখার অবকাশ রয়েছে।

এক অনুষ্ঠানে বড়ে গোলাম আলী, লতাজী, মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা, উৎপলা সেন, অজিত চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা

 

আরও পড়ুন
হেমন্তকণ্ঠে লোকগান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি সংস্করণ, ‘দুর্লভ’ সংকলন যুবকের

পর্দার ও নেপথ্যের নায়ক 'উত্তম-হেমন্ত' জুটির সম্পর্কে গীতশ্রীর একটি মন্তব্য দিয়েই শুরু করা যাক তবে। 'সাধারণত বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকার চূড়ান্ত মিল হয় একেবারে শেষভাগে। তার আগের প্রণয়-পর্বের অনেকটাই বলা হয় গানের মাধ্যমে। ফলে জরুরি ও অবিচ্ছেদ্য হয় সেই গান। ফলে উত্তমকুমারের 'মহানায়ক' হয়ে ওঠার পেছনে গান এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে৷ উত্তমকুমার অভিনীত কটা ছবি আছে যাতে ওঁর (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) গান নেই? এই জায়গাটাতেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খুব একটা বড়ো ভূমিকা হয়তো তাঁর অজান্তেই পালন করে গেছেন, যা বাড়তি বৈশিষ্ট্য যোগ করেছে উত্তমকুমারের কেরিয়ারের ক্ষেত্রে। দুজনেরই খাঁটি প্রফেশনাল অ্যাটিচুড আপাত অপ্রত্যক্ষ থেকেও প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত ও সাহায্য করেছেন দুজনকেই।' 

আরও পড়ুন
অন্য হেমন্ত : গান-ছায়াছবির বাইরের মানুষদের চোখে

গীতশ্রীর এমন অকপট স্বীকারোক্তি আমাদের শ্রদ্ধাবনত করে; আমাদের স্বীকার করতে না-চাওয়া কথা উনি যুক্তি দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছেন সকলের জন্য৷ দুটি বিষয় বলতেই হয়। প্রথমত, এ থেকে অনুমান করা যায় যে তিনি 'উত্তম-হেমন্ত' জুটি নিয়ে কতখানি চিন্তাভাবনা করেছেন এবং দ্বিতীয়ত, এটি একদিকে তাঁর প্রিয় হেমন্তদা এবং তৎসহ মহানায়কের প্রতিও তাঁর বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ইতিহাসকে অবিকৃত রেখে। ঠিক এইভাবেই 'মহানায়িকা' সুচিত্রা সেনের কেরিয়ারের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গী যুক্ত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়— এ কথাও অনস্বীকার্য৷ 

আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলির ইতিহাস ধরে রাখছেন হেমন্ত

ইলা বসু, মান্না দে, তালাত মেহমুদ, উৎপলা-সতীনাথ রাধাকান্ত নন্দী ও আরও অনেকে।

 

যে বিষয় নিয়ে কথা বলা, সেখানেই ফিরে আসি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রথম শোনেন ঢাকুরিয়ার দাশপাড়ার একটি জলসায়। সেদিন হেমন্তবাবুর সঙ্গে তবলাসঙ্গত করেছিলেন গীতশ্রীর ছোড়দা। সেখানেই হেমন্তবাবুর সাথে সামান্য পরিচয় হয় তাঁর। সময়টা চারের দশকের মধ্যভাগ। এরপরে ১৯৪৯ সালে 'স্বামী' ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে প্রথম কণ্ঠদান করলেন সন্ধ্যা। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা সেই গানটি ছিল 'ওরে ঝরা বকুলের দল'। কিন্তু একটা গানের তো রেকর্ড বেরোয় না তখন। তাই রেকর্ডের উল্টোপিঠের জন্য হেমন্তর সুরে এবং গৌরীপ্রসন্নর কথায় আরও একটি গান গাইলেন সন্ধ্যা— 'হৃদয় তোমার ভরিয়ে দেব, ভরিয়ে দেব'। মন মাতানো সুর, গায়কি এবং গান। খুব সম্ভবত এই গানটিই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গীতশ্রীর গাওয়া একমাত্র আধুনিক গান। তারপর ১৯৫১তে নিজের সুরে অজয় করের ছবি 'জিঘাংসা'তে গাইবার জন্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে আবার ডাকলেন হেমন্ত। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গানটি ছিল 'আমি আঁধার, আমি ছায়া'। এই ছবির হিন্দি 'বিশ সাল বাদ'এ এই গানটির একই সুরে 'কঁহী দীপ জ্বলে, কঁহী দিল' গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।

হেমন্ত-সন্ধ্যা-আরতি

 

শচীন দেব বর্মণ সেই সময় অর্থাৎ ১৯৫০ সালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে গেলেন বম্বেতে। তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও রয়েছেন বম্বেতে। যোগ দিয়েছেন ফিল্মিস্তানে। শচীন কত্তার সঙ্গেই এভারগ্রিন হোটেলে ওপরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় থাকতেন। তখনই তাঁর সঙ্গে হেমন্তবাবুর সঙ্গে আলাপ, পরিচয় বাড়তে থাকে। তখন থেকেই ভগ্নীসমা 'সন্ধ্যা'কে কখনও 'তুমি' বা কখনও 'তুই' করে ডাকতে শুরু করেন তাঁর হেমন্তদা। তখন বোম্বেতে পাকাপাকি থাকতে শুরু করেছেন হেমন্ত। ঐ সময়েই '৫১তে এস.ডি. বর্মনের সুরে 'সাজা' ছবিতে হেমন্ত-সন্ধ্যা জুটির প্রথম গান আমরা শুনতে পাই হিন্দিতে রাজিন্দর কিষণের কথায়— 'আ গুপচুপ গুপচুপ পেয়ার করে'। ছবিতে নায়ক দেব আনন্দ ও নায়িকা নিম্মির লিপে ছিল এই গানটি। '৫৪ সালে হিন্দি ছবি 'মনোহর'-এও আমরা হেমন্ত-সন্ধ্যা জুটির গাওয়া 'রাত হ্যায় সুহানী রাত' গানটা পেয়েছি। মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন এস. ভি. ভেঙ্কটরমণ এবং গানটি লিখেছিলেন বি. আদিল।

প্রতিমা-হেমন্ত-আলপনা-সন্ধ্যা-বেলা

 

দুজনেই গান গাইছিলেন সেইসময় হিন্দি ফিল্মে। 'তরানা' ছবিতে লতাজির সঙ্গে ডুয়েট গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়; পরে আরও কয়েকটি ফিল্মে গাইলেন তিনি। এদিকে ১৯৫২তে 'আনন্দমঠ'-এর মিউজিক ডাইরেক্টর ছিলেন হেমন্ত। ফিল্মেও গাইছিলেন, কাজ করছিলেন ফিল্মিস্তানেও। কিন্তু দুজনের কারুরই ঠিক মন বসছিল না বোম্বেতে। এ নিয়ে দুই পরিবারের আলোচনাও হত। গীতশ্রীর দাদা রবীন মুখোপাধ্যায় একবার বললেন হেমন্তকে, পরিবারকে নিয়ে চলে আসুন না, তাহলে মন বসবে। পরে সেরকমই করলেন হেমন্ত। কয়েকবছরের মধ্যেই পরিবারের সকলকে নিয়ে এলেন। কিন্তু এই কয়েকবছরের মধ্যেই ছিল ১৯৫৪ সাল। 'নাগিন' দেশজোড়া খ্যাতি এনে দিল হেমন্তকে। কিন্তু সন্ধ্যা সেখানে রইলেন না।

কলকাতায় আসার পর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ফিল্মে আর রেকর্ডে গান গাইতে লাগলেন। ১৯৫৪ সালে 'অগ্নিপরীক্ষা' ছবিতে মহানায়িকার লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান বেশ জনপ্রিয় হয়। তারপরের বছরই মুক্তি পেল 'উত্তম-সুচিত্রা' জুটির 'শাপমোচন'। উত্তমকুমারের লিপে হেমন্তকুমারের গান যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। প্রতিষ্ঠা পেলেন উত্তমকুমার। অবশ্য এর আগেই 'সহযাত্রী' ছবিতে হেমন্ত উত্তমকুমারের লিপে গেয়েছিলেন, কিন্তু তা তেমন জনপ্রিয় হয়নি। '৫৫তেই একদিন হেমন্ত সন্ধ্যাকে ডেকে বললেন, 'বিকাশবাবু (রায়) 'সূর্যমুখী' নামের একটি ছবি করছেন। আমি মিউজিক করছি। তুই তো এখন খুব ভালো গাইছিস, তো তুই আমার সুরে গাইবি?' রাজি হয়ে গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় এই ছায়াছবির 'আকাশের অস্তরাগে' গানটা শোনেননি হেন বাঙালি বোধহয় নেই। ইতিহাস হয়ে গেল গানটি, খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল সেসময়। এছাড়াও ঐ ছবিতে সন্ধ্যা গেয়েছিলেন 'আমি আর যে পারি না সহিতে' এবং ফিল্মের টাইটেল সংটিও— 'আমি সূর্যমুখী তোমার মুখের পানে'। বর্তমানে এই দুটি গানই বেশ দুষ্প্রাপ্য।

এরপর বেশ কয়েকটি ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজের সুরে গাওয়ালেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। গানগুলোর কথাও বলে রাখি। 'শিকার' (১৯৫৮) ছবিতে 'শরমে জড়ানো আঁখি' এবং 'না জানি কোন ছন্দে', 'সূর্যতোরণ' (১৯৫৮) ছবিতে 'ওগো অকরুণ' ও 'দুয়ারখানি বাতাস এসে', 'সোনার হরিণ' (১৯৫৯) ছবিতে 'এই যে চাঁদের আলো' এবং 'অগ্নি সংস্কার' ছবিতে 'এই সুন্দর রাত্রি', 'একটি সুখে নীড়' ও 'আমার দুয়ারখানি' গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। প্রত্যেকটি গানেরই গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন। 

এরপর এল সেই ঐতিহাসিক ছায়াছবি 'সপ্তপদী'।

Powered by Froala Editor

More From Author See More