‘এক বেলার মধ্যেই ফুরিয়েছিল সন্ধ্যাদির অনুষ্ঠানের সমস্ত টিকিট’

বছর খানেক আগের কথা। সন্ধ্যাদির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল আমার। ‘হারমোনিকা’-র মঞ্চে বাংলার যে সমস্ত কিংবদন্তি শিল্পীরা অনুষ্ঠান করেছেন, সেইসব স্মৃতি নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশের চিন্তাভাবনা ছিল আমার। সন্ধ্যাদির কাছে আমার প্রস্তাব ছিল, যদি তিনি গ্রন্থটির মুখপত্রটি লিখে দেন। এক বাক্যেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন সন্ধ্যাদি (Sandhya Mukhopadhyay)। অসুস্থতার মধ্যেও একটানা ৩৫ মিনিট কথা বলেছিলেন আমার সঙ্গে। পাণ্ডুলিপি চেয়েছিলেন বইটির। অসম্পূর্ণই রয়ে গেল সেই কাজ। সন্ধ্যাদি আর নেই, এটা বিশ্বাস করাই কঠিন।

সন্ধ্যাদির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ‘হারমোনিকা’-র সূত্রেই। ২০০৬ সালে ‘হারমোনিকা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর থেকেই আমি ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছি সন্ধ্যাদির সঙ্গে যোগাযোগ করার। বলতে গেলে, তখন সঙ্গীত জগৎ থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। মঞ্চ অনুষ্ঠান করেন না আর। ২০০৮ সালের জন্মাষ্টমীর ঠিক পরের দিন, আমাকে চমকে দিয়ে সন্ধ্যাদির সম্মতিপত্র এসে পৌঁছাল আমার হাতে। তখনও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, সন্ধ্যাদি হারমোনিকার মঞ্চে একক এবং দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। 

অনুষ্ঠানের আগে দু’বার ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি এবং সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন সন্ধ্যাদি। তাছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে গান নিয়ে আলোচনা করেছেন দীর্ঘক্ষণ। সঙ্গীতের প্রতি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যে কতটা নিষ্ঠা, সেটা বলে বোঝানো ভীষণ কঠিন। ওঁর স্নেহ, আতিথেয়তার কথাও বিশেষভাবে বলতে হয়। প্রতিবার নিজে হাতে রান্না করে খাইয়েছেন আমাকে।

আরও পড়ুন
অজস্র ‘আধুনিক’ গানের পরও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ সন্ধ্যা

২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে সেই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল। এখনও মনে আছে এক বেলার মধ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল সমস্ত টিকিট। ২৭২৫টি টিকিট— সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে এমন দ্বিতীয় কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা, আমার জানা নেই। শুধু এর থেকেই তাঁর পরিধির পরিচয় পাওয়া যায়। পরিচয় পাওয়া যায়, তিনি কতটা বড়ো শিল্পী ছিলেন।

আরও পড়ুন
হেমন্তকণ্ঠে লোকগান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি সংস্করণ, ‘দুর্লভ’ সংকলন যুবকের

সেদিনও গাড়ি থেকে নেমে আমার হাত ধরে মঞ্চে উঠেছিলেন সন্ধ্যাদি। একক এবং মান্না দে-র সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন তিনি। সুরের আবহে সেদিন ভেসে গিয়েছিল গোটা অডিটোরিয়াম। হারমোনিকার মঞ্চে সেই সঙ্গীত পরিবেশনই সন্ধ্যাদির জীবনের শেষ অনুষ্ঠান। হারমোনিকার পক্ষ থেকে সন্ধ্যাদিকে বিশেষ সম্মাননা জ্ঞাপন করেছিলাম আমরা। সন্ধ্যাদিও শুভেচ্ছা লিখে দিয়েছিলেন নিজে হাতে। সেটা পরম প্রাপ্তি। 

আরও পড়ুন
অন্য হেমন্ত : গান-ছায়াছবির বাইরের মানুষদের চোখে

মানুষটা ভেতরে কতটা কোমল, স্নেহপরায়ণ ছিলেন— তা ওঁর সঙ্গে না মিশলে বোঝা শক্ত। অনুষ্ঠানের পর বহুবার ওঁর বাড়িতে ডেকেছেন সন্ধ্যাদি। অনুষ্ঠানের ছবি, রেকর্ড ওঁর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি আমি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেই তো বড়ো হয়ে ওঠা। সত্যি কথা বলতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মানেই আমাদের কাছে সুচিত্রা সেন। সেইসব টুকরো টুকরো গল্পের স্মৃতিচারণ করতেন সন্ধ্যাদি। ওঁর রেওয়াজের ঘরেই যেন ফিরে ফিরে আসত বাংলার স্বর্ণযুগ। 

ওঁর ঠাকুর ঘরের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। সঙ্গীতসাধনার বাইরে, আরাধনায় ডুবে থাকতে ভীষণ ভালোবাসতেন সন্ধ্যাদি। আমাকে ঘুরিয়ে দেখাতেন ওঁর ঠাকুর ঘর। বহু বাড়িতেই ঠাকুরঘর দেখেছি, তবে সন্ধ্যাদির সাধনা সেসবের ঊর্ধ্বে। ফোনে আমার কেদারযাত্রার কথা শুনে কী যে খুশি হয়েছিলেন, তা বলে বোঝানোর মতো নয়। 

শুধু বাংলা ভাষায় সীমাবদ্ধ নয়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গোটা ভারতবর্ষের অন্যতম মহান একজন সঙ্গীতশিল্পী। সন্ধ্যাদি এত বড়ো মাপের মানুষ এবং সঙ্গীত সাধক, কোনো বিশেষণেই বিশেষিত করা যায় না ওঁকে। সন্ধ্যাদি চলে যাওয়ায় সঙ্গীতের একটি অধ্যায় শেষ হল ঠিকই। কিন্তু ওঁর গানের মধ্যে দিয়েই সন্ধ্যাদি বেঁচে থাকবেন আজীবন। ওঁর শিল্প, সৃষ্টি মৃত্যুর পরিধির বাইরে…

[লেখক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘হারমোনিকা’-র প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সম্পাদক।]

Powered by Froala Editor

More From Author See More