রবীন্দ্রনাথের ‘নির্জন এককের গান’ ও ঋতু গুহ 

ঋতু গুহ (Ritu Guha), ঋতুদির গলায় রবীন্দ্রগানের অভিমুখ যেন শতাব্দী অতিক্রম করে। এই প্রার্থনা রাখি। তিনি প্রবাদপ্রতিম এবং রবীন্দ্রনাথের গানে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিবেদক শিল্পী হিসেবে বরণীয়।

ঋতুদির গান যে-কোনো তথ্য, তত্ত্ব কি আপাতজীবনের তুচ্ছতার অনেক ঊর্ধ্বে বিচরণ করে। রবীন্দ্রগানের চিরকাঙ্খিত রূপ তাঁর কণ্ঠধারণ করত। সম্ভ্রম, ভাবপ্রকাশে নিয়ন্ত্রণ, সুর ও গানের কথার সমতা তাঁর গায়ন শৈলীকে অনন্য করে রেখেছে। তাঁর কন্ঠে গীত যে কোনো গানে, রবীন্দ্রগানের ধ্রুপদী রূপটি ফুটে উঠত। রবীন্দ্রগানে এটি তাঁর শ্রেষ্ঠতম অবদান।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের (Rabindrasangeet) সব ধরনের গানে তিনি আত্মবিস্মৃত ও গহন নিবেদনে মগ্ন দেবী হয়ে উঠতেন। যে-কোনো অঙ্গের গান তিনি গাইতে পারতেন সমান দক্ষতায়। যত সময় গড়িয়েছে তাঁর গানে রবীন্দ্র দর্শন, অনুভব ও গভীরতার  বিচ্ছুরণ তত উজ্জ্বল হয়েছে। রবীন্দ্রগান যে সমস্ত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বাউলাঙ্গ, কীর্তনাঙ্গ, টপ্পাঙ্গ— এ সকল ধারার একটি সংমিশ্রণ কি নির্যাস, তা তাঁর গান শুনলেই বোঝা যেত। 

তাঁর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত ঠিক কী ছিল, নিজে গান গেয়ে প্রমাণ করেছেন ঋতুদি। জীবনে ও গায়নে। তাঁকে ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। নিজের জীবনচর্যা দিয়ে তিনি রবীন্দ্রগানকে দেখতেন। চলার পথের সব দিকের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি তাঁর সততা ছিল একশো শতাংশের বেশি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের মান নিয়ে সর্বদা সচেতন থাকতেন ঋতুদি। যখন তাঁর মনে হয়েছে তাঁর গলা সঙ্গ দেয়নি, তখন নিজেকে গান থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। বহু প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে। একেক সময়ে এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন হত। কিন্তু দেখতে গেলে ঋতু গুহ এবং শ্রেষ্ঠতম মানের সঙ্গীত নিবেদন প্রায় সমার্থক। আর সে জন্যই হয়তো অন্তত তিন-চার যুগকে তিনি ধরে রেখেছিলেন নিজের গান দিয়ে। ঋতু গুহ নিজেই এক রবীন্দ্রনাথের গানের চিরনবীন এবং চিরবৈচিত্রময় এক অধ্যায়।

ঋতুদি আদ্যন্ত প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন। আজকাল যেভাবে একজন শিল্পী নিজেকে বিপণন করেন, তিনি সেরকম দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। সময়ের বদলের সঙ্গে তিনি আরও নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর বাইরের রূপ কঠিন-কোমল হলেও অন্তর ছিল কোমল-করুণার মানস সরোবর। ঋতুদি কতটা সরল, স্নেহশীলা, শিশুসুলভ ছিলেন, যাঁরা তাঁকে সামনে থেকে দেখেননি, তাঁর সঙ্গ পাননি, তাঁদের পক্ষে বোঝা কঠিন। এখানে তাঁর প্রকৃত এবং যথাযথ শিল্পসত্তা বিমূর্ত হয়ে উঠল। তিনি ছিলেন তাঁর নিজের নন্দন ধারার শীর্ষমানের চিত্রকর। শিল্পের প্রকৃত দানী ও বাহিকা।

আমি জানি না, ইতিহাস কীভাবে ঋতুদিকে মনে রাখবে। কিন্তু সময় এসেছে একটা কথা বলার। রবীন্দ্রগান যখন একটা ধারায় চলছিল তখন কিছু অধরা-ধারা ছিল। যার মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু রাগাশ্রয়ী রবীন্দ্রনাথের গান। সেইসব গানকে রাবীন্দ্রিক রূপ দেওয়া আয়াসসাধ্য ছিল। তিনি প্রাত্যহিকতা ও আপাত জনপ্রিয়তার ভাবনাকে উপেক্ষা করে বহু রবীন্দ্রগানকে প্রথম বারের মত শ্রোতার কাছে অবিরাম তুলে ধরেছেন। গত ১৪০ বছরের রবীন্দ্রগানের ইতিহাস এই কথাই বলে। 

রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে সর্বকালের সেরা তিন মহিলা কণ্ঠশিল্পীর মধ্যে তাঁর নাম সতত উজ্জ্বলতায় ভাসবে।

দুঃখজনক ভাবে, বিশেষত রবীন্দ্রগানের সঙ্গে বরাবর ব্যক্তিগত রাজনীতিও তো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ ধরনের সংকীর্ণতা অন্য গানের ধারায় লক্ষিত নয়। এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা শিল্পী বা গায়ন ব্যক্তিত্ব কিংবা প্রতিষ্ঠান কাউই যোগ্য প্রতিভাকে সফল দেখতে চাই না। ব্যতিক্রম, সর্বজন শ্রদ্ধেয়া মায়া সেন। ফলে, রবীন্দ্রসঙ্গীত যেখানে পৌঁছানোর ক্ষমতা ছিল, আজ সেখানে পৌঁছতে পারেনি। তবে বিশ্বাস রাখি, এ গানে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে আগাম শিল্পীরা যারা সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্দ্ধে থেকে রবীন্দ্রগানকে সমস্ত সম্ভাবনাসহ নিয়ে এগিয়ে যাবে। 

বলতে গেলে, ঋতু গুহ রবীন্দ্রসঙ্গীতচর্চার একটি অধ্যায়। তিনিও বহুক্ষেত্রে ও স্মরণে উপেক্ষিতা। রবীন্দ্রনাথের গানে এর থেকে বড়ো বেদনার কারণ হতে পারে না। যথাযথ বিচার করলে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্রের গানের 'খেয়ার কূলে' তাঁর বাড়ি এবং কোনো ভাবেই তাঁদের থেকে পিছিয়ে থাকেননি, স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। বহু ক্ষেত্রে বরং তাঁদের দিক থেকে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর সাঙ্গীতিক ক্ষমতা প্রশ্নাতীত এবং চিরস্মরণীয়। এবং রবীন্দ্রনাথের গানে যে কোমল ঋজুতা ধরা পড়ত, তা রবীন্দ্রনাথের গানে চিরপ্রেক্ষিত। 

এ কথা ভুলে গেলে ক্ষতি রবীন্দ্রসঙ্গীতের। তাই আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর গানের কথা আরও বেশি করে আলোচনায় তুলে আনাই আবশ্যিক। ঋতুদি নিজের জীবন দিয়ে রবীন্দ্রগানকে এঁকেছেন। শ্রোতাদের চলার পথ আলোকিত করতে। তিনি তো বহুদূরে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁর শিল্পী সত্তা ও রবীন্দ্রগানে তাঁর অবদান শ্রোতার বুকে চিরমননের সঙ্গে বাঁচুক এ প্রার্থনা রাখি।   

কয়েকটুকরো স্মৃতি তথা 'পাড়ানির কড়ি' দিয়েই তাঁর তর্পণ করা যাক বরং।

এক 

এ ঘটনার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত  আমি জানিনা আমার জীবনে কী ঘটতে চলেছে। ১৯৮৪ সাল। প্রথম একটি একক অনুষ্ঠানে ঋতুদির গান শুনি। আমার তখন ১৬ বছর বয়স। রবীন্দ্রগান সম্বন্ধে সম্যক ধারণা সেই অর্থে ছিল না। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে ঋতু গুহর গান শোনার পর আমার মনে হয়েছিল, এই গানই আমার জীবনের গতি। শিল্পী হিসাবে এমনই অনন্য ছিলেন ঋতুদি, যিনি তাঁর রবীন্দ্রগানের শক্তিতে মানুষের জীবন, মনন পরিবর্তন করে দিতে পারতেন। তারপর থেকে শুধু গানের নয়, তাঁর কাছে রবীন্দ্রজীবনের পাঠ নিয়েছি দীর্ঘ ২৭ বছর। এ এক নক্ষত্রলোক, একই সাথে এক আলোকবর্তিকা। যা প্রতিদিন নতুন জন্ম এনে দিতে পারে। যেমনটি আমার হয়েছিল ৩৭ বছর আগে। 

দুই

অনেক বছর আগের কথা। সেবার ঋতুদি আমাদের শান্তিনিকেতনে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলেন। শীতের সময় ছিল সেটা। নিজে হাতে রান্না করতেন, পরিবেশন করতেন, থালা তুলে নিতেন। কী লজ্জার কথা। 

সে বার ফিরছি। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। হাওড়া স্টেশনে ঢুকছে।  বিকেল চারটে, সাড়ে চারটে বাজে। সূর্য প্রায় ঢলে এসেছে। মারো পেরিয়ে শ্রী - পূরবীর পালা এবার। সকলে বসে আছি আমরা। বাইরের দিকে চেয়ে। হঠাৎ দিদি ধীর গলায় গান ধরলেন, ‘দিন যায় রে, দিন যায়’। কোমল ঋষভ দিদিকে ছেয়ে ফেলেছে। আমরা দেখলাম দিদি গাইছেন আর তাঁর দু’চোখ ছলছল করছে। জীবনের সব তুচ্ছতা সরিয়ে এ ভাবেই তিনি সজল হয়েছেন গানের কাছে। আর কৃপাবর্ষণ করছেন ঋতু গুহ। আপামর শ্রোতাকে। গানের যে বলিষ্ঠ এবং একই অঙ্গে কোমল রূপ হানতেন তা বিস্ময়কর। বড়ো বিস্ময়কর।

এই দু’টি ব্যক্তিগত স্মরণ থাকুক আপাতত। এ কথন অনন্তের পথচলাও হতে পারে।

(লেখক ঋতু গুহের ছাত্র এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।)

Powered by Froala Editor

More From Author See More