পরীক্ষায় ফেল, ঘুরে দাঁড়িয়ে ঋতুজয়— বুদ্ধদেবের প্রেমকাহিনি হার মানায় উপন্যাসকেও

বাবার ইচ্ছা, ছেলে অ্যাকাউন্টেন্সি নিয়ে পড়বে। অথচ ছেলের মন সবসময় পড়ে থাকে প্রকৃতির মাঝখানে। শহর কলকাতার মধ্যে যেন একটুখানি নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা তার গানের স্কুল। তবে সেখানেও নিয়মের কড়াকড়ি নেহাৎ কম নয়। মনটা মাঝে মাঝে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দূর ছাই বলে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু গানের স্কুল ছাড়া হয় না শেষ পর্যন্ত। এখানেই যে দেখা হয়ে গেল তার সঙ্গে। বাসন্তী রঙের শাড়ি, দুই বিনুনির আরেক শিক্ষার্থী। গানের অনুষ্ঠানে ছেলেটি তখন কোরাসের দলে। আর মেয়েটি গাইল একক রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’। এভাবেই শুরু। আর তারপর, তারপর একটা গল্পের শুরু। যে গল্পকে নিজের ভাষাতেই পরে লিখে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটিও আর কেউ নন, লেখক স্বয়ং।

দক্ষিণী সঙ্গীতবিদ্যালয়ে প্রথম দেখা ঋতু গুহঠাকুরতার সঙ্গে। ঋতু গুহঠাকুরতা, দক্ষিণীর প্রতিষ্ঠাতা শুভ গুহঠাকুরতার ভাইঝি। তবে সেই পরিচয় তখনও জানেন না বুদ্ধদেব। তিনি শুধু গান শুনেছেন। এভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে যেন আগে কাউকে কোনোদিন শোনেননি। বয়সের ধর্ম, শুধুই গানের অ্যাডমায়ারার হয়ে থাকলে মন মানে না। হয়ে উঠতে হবে তার চেয়ে বেশি কিছু। খোঁজ খবর নিয়ে গায়িকার পরিচয় জানা গেল। আর পরিচয় জেনেই স্তম্ভিত হয়ে রইলেন বুদ্ধদেব। স্বয়ং শুভ গুহঠাকুরতার ভাইঝি ঋতু, যাঁর দাপটে সবসময় নিয়মের কাঁটা মেনে এগিয়ে চলেছে দক্ষিণী। কীভাবে জানাবেন তাঁকে মনের কথা? দিন যায়, মনের মধ্যে আরও তীব্র হয়ে ওঠে চাহিদা। এর মধ্যেই আশুতোষ কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেবের একেবারে কাছে বসে সঙ্গীত পরিবেষন করেন ঋতু। একটি ঘরোয়া নাটকেও এক মঞ্চে উঠে আসেন দুজনে। বুদ্ধদেব নাটকের অভিনেতা, আর ঋতুর চরিত্র সামান্যই। একটি অনুষ্ঠানে গান শোনানোই তাঁর কাজ।

বলি বলি করেও বলা হয়ে ওঠে না কিছুই। ওদিকে বাড়িতে বাবার কড়া শাসন। গান করো, নাটক করো – কিছুতেই আপত্তি নেই। কিন্তু পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে চলবে না। কিন্তু অ্যাকাউন্টেন্সির হিসাব ততদিনে মাথায় উঠেছে। বই সামনে নিয়ে বসে থাকেন, কিন্তু হিসাব এগোয় না। খাতাজুড়ে ভর্তি হয় অসংখ্য কবিতার লাইন। সেইসবও ছিঁড়ে ফেলেন নিজেই। এর মধ্যে বারকয়েক ঋতুদের বাড়িতেও গিয়েছেন। বাড়ির সকলের সঙ্গেই তাঁর যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক। শুধু ঋতু সামনে এসে দাঁড়ালেই আত্মবিশ্বাসে ছেদ পড়ত। ঋতুও যেন এড়িয়ে যেতেন তাঁকে। কখনও বিশেষ কাজ দেখিয়ে, কখনও শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে সরে পড়তেন। ঋতু কি তাহলে প্রত্যাখ্যান করছেন বুদ্ধদেবকে? এই চিন্তাই তখন সবসময় ঘিরে থাকত। ফলে যা হওয়ার তাই হল একদিন। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হল। ডাহা ফেল করেছেন বুদ্ধদেব। বরাবর মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত তিনি। তবে নিজে যেন জানতেন এই ফল আসবেই একদিন। জেনেও মেনে নিতে পারেননি।

এবার আরও কড়া হলেন বাবা। গান, নাটক সব বন্ধ। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, তবে অন্য চিন্তা। বাড়ি থেকেও আর খুব একটা বাইরে যান না বুদ্ধদেব। পড়াশোনার চেষ্টা করতে থাকেন, কিন্তু চেষ্টায় কিছুই হয় না। মনের মধ্যে তখনও ঋতুর মুখটা উজ্জ্বল। একদিন খবর পেলেন, ঋতুর গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে। গ্রামোফোনের দোকানে ছুটলেন সেই অ্যালবাম কিনতে। বাড়িতে বসে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুনলেন গান। শুনতে শুনতে তাঁর নিজের বুকই গর্বে ভরে উঠেছিল। এরপর মাঝে মাঝেই রেডিওতে ঋতুর গানের অনুষ্ঠান হয়। সবসময় খবর রাখা হয় না। কিন্তু কখনও পাশের বাড়ি থেকে চেনা গলা ভেসে এলেই নিজের ঘরে রেডিও খুলে বসেন তিনি। বিষয়টা যেন মায়ের কাছেও আর অস্পষ্ট থাকল না। একদিন সরাসরি তিনি প্রশ্ন করলেন ছেলেকে। আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, এতে তাঁর সায় নেই। বুদ্ধদেব শুধু বললেন, একবার অন্তত না দেখে এভাবে আপত্তি করা উচিৎ নয়।

বললেন তো। কিন্তু দেখা করাবেন কার সঙ্গে? ঋতুকেই যে এখনও বলা হয়নি কিছু। যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন তিনি এঁকেছেন, তা যে এখনও তাঁর নিজস্ব ক্যানভাসে বন্দি। শেষ পর্যন্ত সাহসে ভর করে লিখেই ফেললেন একটা চিঠি। প্রেম নয়, সরাসরি জীবনসঙ্গিনী হওয়ার প্রস্তাব। লিখলেন ঠিকই, তবে উত্তর এল না। অপেক্ষার চৌকাঠে ধুলো জমে। হঠাৎই একদিন ফোন এল ঋতুর বোনের কাছ থেকে। ঋতু দেখা করতে চান। দুদিন পরেই রেডিওর একটা অনুষ্ঠান আছে। সম্ভব হলে সেদিনই। বুদ্ধদেব কাজের অজুহাত দিলেন ঠিকই, কিন্তু মনে মনে ঠিক করে নিলেন দেখা তাঁকে করতেই হবে। সঠিক সময়ে হাজির হলেন স্টুডিওর সামনে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধার। গঙ্গার ধার থেকে একটি কফিশপে। কিন্তু কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে একটার পর একটা স্ট্র ভেঙে ফেলছেন ঋতু। হাত কাঁপছে থরথর করে। ভবিষ্যতের স্বপ্নটা যে কবে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে, টের পাননি বুদ্ধদেব। বাইরের গাম্ভীর্যের আড়ালে নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রেখেছেন ঋতু। সেদিন তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি ঋতুকে যতটা চেয়েছেন, তার থেকেও যেন ঋতু ছেয়েছেন আরও অনেক বেশি। আর সেই কারণেই বিশ্বাসের জোর ছিল তাঁর কাছে।

পথচলার শুরুতেই ঋতু শুধু বলেছিলেন, জীবনে অনেক বড়ো হতে হবে বুদ্ধদেবকে। সামনের পরীক্ষাতেও সফলভাবে পাশ করতে হবে। কথা রেখেছিলেন বুদ্ধদেব। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর পাশাপাশি অ্যাকাউন্টেন্ট বুদ্ধদেব গুহর সাফল্যও কোনো অংশে কম নয়। আর ঋতু গুহ? রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে নিজেকে তো প্রতিষ্ঠিত করেছেনই, সেইসঙ্গে গানপাগল বুদ্ধদেবের জীবনকেও ভরিয়ে রেখেছিলেন সুরে। বুদ্ধদেব গুহ বলতেন, জর্জ বিশ্বাস নন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় নন, সুচিত্রা মিত্র নন – তাঁর কাছে শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পীর নাম ঋতু গুহ। দাম্পত্যের বোঝাপড়া বোধহয় একেই বলে। যে বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে সম্পর্কের টানাপোড়েন, সামাজিক বেড়াজাল ভেঙে যৌবনের উচ্ছ্বল আনন্দকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করেননি; তাঁকেও কিন্তু সমাজের বোঝাপড়ার কাছে হোঁচট  খেতে খেতে এগোতে হয়েছে। তবে থেমে থাকেননি। নিজের ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন সম্পূর্ণটা দিয়ে।
তথ্যসূত্রঃ খেলা যখন, বুদ্ধদেব গুহ

Powered by Froala Editor

More From Author See More