বন্ধ হচ্ছে ১৬৪ বছরের পুরনো আলিপুর জেল প্রেস

কলকাতার আদি গঙ্গার গা ঘেঁষে উঠে যাওয়া ২১ ফুট উঁচু প্রকাণ্ড লাল দেওয়াল যেন অতন্দ্র প্রহরী। আর তা হবে নাই বা কেন? এই দেওয়ালের পিছনেই যে ঠিকানা কুখ্যাত আসামিদের। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে আলিপুর জেল নিয়েই। কিন্তু এহেন কারাগারের একটি বিশেষ অংশে ঢুকে পড়লে চমকে উঠতে বাধ্য যে কেউ। কারাগারের মধ্যেই উত্তর-দক্ষিণের সাত-সাতটি ঘরজুড়ে রয়েছে আস্ত এক ছাপাখানা!

বছর দুয়েক আগের কথা চিরকালের মতো তালা পড়ে যায় ঐতিহাসিক আলিপুর কারাগারে। তবে সংশোধনাগার তার মূল কার্যকারিতা হারালেও, এতদিন পর্যন্ত টিম টিম করে জেগে ছিল আলিপুর জেলের সেই ঐতিহ্যবাহী ছাপাখানা। এবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেই দরজাও।

আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগে আলিপুর কারাগার তৈরি করে ব্রিটিশরা। লক্ষ্য ছিল, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আটক করে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের তথ্য বার করে আনা। তবে শুধু কারারুদ্ধ করাই নয়, অপরাধের মাত্রার ওপর নির্ভর করে বন্দিদের জন্য বরাদ্দ হত বিভিন্ন কাজ। কারোর ভাগ্যে জুটত হাড়ভাঙা খাটুনি। আবার কেউ পেতেন লঘু কাজকর্ম। 

এই লঘু কাজকর্মের তালিকাতেই অন্যতম ছিল ছাপার কাজ। ১৮৫৭ সালে আলিপুর জেলের তৎকালীন সুপারিটেন্ডেন্ট মিস্টার ফ্লয়েডের তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছিল এই মুদ্রণ কর্মসূচি। ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে তিনিই গড়ে তুলেছিলেন আস্ত ছাপাখানাটি। জেলের উত্তর ও দক্ষিণের সাত-সাতটি বিশালায়তন ঘরে বসেছিল মুদ্রণযন্ত্র। সেই যন্ত্র আনানো হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম টাইপসেটিং কোম্পানি কুইন্সফেরির প্যারাগন থেকে। ছাপা হত কিংবদন্তি ফিগিন্স কোম্পানির হরফে। তৎকালীন কলকাতায় এহেন উন্নতমানের ছাপাখানা ছিল এককথায় অদ্বিতীয়। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর হারিয়ে যাওয়া ছাপাখানার খোঁজে কলকাতার লেখক

তবে হাতে গোনা কয়েকজন স্থপতি ও পরিচালক ছাড়া গোটা মুদ্রণ কর্মসূচির দায়িত্বে ছিলেন জেলের কয়েদিরাই। এই প্রেসে মূলত বিভিন্ন সরকারি নথি এবং নির্দেশিকা ছাপা হত সেসময়। পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন গ্রন্থ, এমনকি বাংলা বই-ও ছাপা হয়েছিল আলিপুর জেল প্রেসে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জেমস লং সাহেবের ‘দৃষ্টান্তরত্ন’। 

আরও পড়ুন
ক্ষয়ক্ষতিতে আয়লা-আমফানকেও ছাপাল ইয়াস? আশঙ্কা সুন্দরবনকে ঘিরে

১৮৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে আলিপুর জেল স্থানান্তরিত হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। সেইসময় প্রথমবারের জন্য সাময়িক বন্ধ হয়েছিল এই ছাপাখানা। ধীরে ধীরে মুদ্রণের গোটা ব্যবস্থাপনাই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। কয়েক দশক পর, বিশ শতকের শুরুতে পুনরায় আলিপুরে প্রত্যাবর্তন করেছিল এই ঐতিহাসিক প্রেস। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবেই কাজ চালিয়ে গেছে আলিপুর জেলের এই ছাপাখানা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে যন্ত্রের পরিবর্তনও। 

আরও পড়ুন
অন্ধত্বের শিকার সন্তান, ৩৫ বছর ধরে দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেইল ছাপাচ্ছেন মার্কিন মহিলা

বছর দুয়েক আগে ২০১৯ সালে চিরকালের মতো তালা পড়ে যায় আলিপুর জেলে। বন্দিদেরও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অন্যত্র। তবে তারপরেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল ঐতিহাসিক প্রেসটি। কিন্তু এত বড়ো একটি ছাপাখানা চালানোর মতো শ্রমিক কই? তাঁরা যে ছিলেন মূলত কয়েদিই। এখন সেই জায়গাতেই যে ধূধূ শূন্যস্থান। ফলত, বাধ্য হয়েই এই ছাপাখানা বন্ধ করতে হচ্ছে জেল কর্তৃপক্ষকে। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই প্রেস অন্যত্র স্থানান্তরিত করার কোনো চিন্তাভাবনাও নেই প্রশাসনের। 

তবে সে-বছরই রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ঘোষণা করেছিল ঐতিহাসিক কারাভবনটি সংরক্ষণের কথা। জানানো হয়েছিল, কারাগারের মধ্যে গজিয়ে ওঠা আগাছা পরিষ্কার করে তার একাংশে গড়ে উঠবে দুটি সংগ্রহশালা। কিন্তু তখনও পর্যন্ত আলিপুর জেল প্রেস সচল থাকায়, বিশেষভাবে তার সংরক্ষণের জন্য সেই সময় আলাদা করে ঘোষণা করা হয়নি কিছুই। এখন দেখার আগামীতে ঐতিহ্যবাহী এই প্রেস সেই সংরক্ষণ কর্মসূচিতে আদৌ জায়গা করে নিতে পারে কিনা। তা নাহলে হয়তো, নীরবেই মুছে যাবে কলকাতা এবং বন্দিশালার মুদ্রণের ইতিহাস…

তথ্যঋণ – সুস্নাত চৌধুরী, মুদ্রণ ফাউন্ডেশন

Powered by Froala Editor

More From Author See More