অজস্র ‘আধুনিক’ গানের পরও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ সন্ধ্যা

সময়টা ’৬০-এর দশকের শেষদিক। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ (Ustad Bade Ghulam Ali Khan) তখন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। তার মধ্যেই বেশ কিছুদিন আসরে গান গেয়েছেন। কিন্তু একদিন ইউনানি চিকিৎসক বললেন, গান গাওয়া আর কোনোভাবেই যাবে না। ঠিক এমনই এক দিন উস্তাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন তাঁর শিষ্যা। শিষ্যাকে দেখামাত্র হঠাৎই সরগম গেয়ে উঠলেন উস্তাদ। তারপর শিশুর মতো হাসতে হাসতে বললেন, চিকিৎসক বারণ করলেই বা কী যায় আসে? এখনও আগের মতোই ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেয়ে যেতে পারেন তিনি। বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের জীবনের শেষ দিনের সেই ঘটনার কথা শুনিয়েছিলেন সেই শিষ্যা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

অবাক লাগে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (Sandhya Mukhopadhyay) নিজেই বলেছিলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনো ধরনের গান পছন্দ করতেন না বড়ে গোলাম আলি সাহেব। এমনকি লোকসঙ্গীতও না। সঙ্গীতের বিশুদ্ধতার প্রতি ছিল তাঁর সদা সতর্ক দৃষ্টি। অথচ তাঁর অন্যতম প্রিয় শিষ্যা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় রপ্ত করেছিলেন দুই ধারাকেই। শুধু রপ্ত করেছিলেন বললে ভুল হবে, দুই ধারাতেই তিনি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি। অবশ্য আধুনিক গান এবং ছায়াছবির গানের আড়ালে তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চার কথা অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছে। এখনও হয়তো কারোর কারোর মনে আছে, আকাশবাণী কলকাতা ‘ক’-এ সকাল সাড়ে আটটা এবং রাত নটার সময় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সুরেলা উপস্থিতির কথা। এছাড়াও অসংখ্য প্রকাশ্য অনুষ্ঠান তো রয়েছেই।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। অবশ্য সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। বংশের পূর্বপুরুষ রামগতি মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে পরিবারে সঙ্গীতচর্চার শুরু। তিন প্রজন্ম পরে নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ও সেই চর্চাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। নরেন্দ্রনাথের স্ত্রী হেমপ্রভা দেবীও টপ্পা গাইতেন। আর তাঁদেরই সন্তান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। খুব অল্প বয়সেই তাই সঙ্গীতশিক্ষার শুরু তাঁর। এর মধ্যে এইচএমভি থেকে রেকর্ডও বেরিয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মন পড়ে থাকে পাতিয়ালা ঘরানার সঙ্গীতে। রেডিওতে বড়ে গোলাম আলি খাঁয়ের অনুষ্ঠান মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন তিনি। একদিন দাদা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে আবদার করলেন, বড়ে গোলাম আলির কাছে গান শিখতে চান সন্ধ্যা। ঘটনাচক্রে উস্তাদজি তখন রয়েছেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিকশন লেনের বাড়িতে।

১৯৪৯ সালের এক শীতের সন্ধ্যায় ডিকশন লেনের সেই বাড়িতে উপস্থিত হলেন সন্ধ্যা। ভয়ে ভয়ে শোনালেন জৌনপুরী রাগের আলাপ। আর সেদিনই উস্তাদজি ছোলা এবং গুড় ভরে দিয়েছিলেন সন্ধ্যার মুখে। সন্ধ্যাও একইভাবে ছোলা-গুড় খাইয়েছিলেন উস্তাদজিকে। তারপর সন্ধ্যার হাতে লাল সুতো বেঁধে দিলেন উস্তাদজি। পাতিয়ালা ঘরানায় এই উপচারকে বলা হয় ‘গান্ডা’ বেঁধে দেওয়া। এভাবেই বড়ে গোলাম আলির শিষ্যা হয়ে গেলেন সন্ধ্যা। তবে এর পরের পথটা খুব সহজ ছিল না। এর মধ্যে বহু শিক্ষকের কাছে গান শিখেছেন সন্ধ্যা। তাঁদের গানের মেজাজ, রীতি— সবই অন্যরকম। পাতিয়ালা ঘরানাকে আত্মস্থ করা খুব সহজ ছিল না।

আরও পড়ুন
গান্ধীজির আদর্শে আজীবন লড়াই, পদ্মশ্রী পেলেন দমনের বৃদ্ধা স্বাধীনতা সংগ্রামী

খুব বেশিদিন বড়ে গোলাম আলির কাছে সঙ্গীতশিক্ষার সুযোগও পাননি সন্ধ্যা। উস্তাদজিকে তখন সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে হয় অনুষ্ঠানের জন্য। তবে উস্তাদজিই শিখিয়েছিলেন, সঙ্গীতশিক্ষার প্রথম শর্ত বারবার গান শোনা। শুনে শুনে সঙ্গীতকে বোঝার কান তৈরি করা। আর উস্তাদজির গান শুনতে সন্ধ্যাও তাই ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের নানা প্রান্তে। কোথাও কোথাও গুরুর সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করেও নিয়েছেন তিনি। ১৯৫৭ সালের উত্তরপাড়ার ‘সঙ্গীতচক্র কনফারেন্স’-এর কথা তো অনেকেই জানেন। সারা রাতের সেই অনুষ্ঠানে একসঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন বড়ে গোলাম আলি খাঁ এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন
গান্ধী-আদর্শে লড়াই, কুষ্ঠ রোগীদের পাশে দিল্লির সমাজকর্মী

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং মুনাব্বর আলি খাঁয়ের যুগলবন্দিও এক কিংবদন্তি। বড়ে গোলাম আলি খাঁয়ের পুত্র মুনাব্বর খাঁ। তাঁর পরিচালনায় ১৯৭১ সালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের লং প্লেইং রেকর্ড প্রকাশ করল এইচএমভি। আর এর ঠিক ৮ বছর পর সন্ধ্যা ঠিক করলেন, বড়ে গোলাম আলি খাঁয়ের কিংবদন্তি ঠুংরিগুলি বাংলায় গাইবেন তিনি। এবারেও পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন মুনাব্বর খাঁ।

আরও পড়ুন
ডেনভারের ‘দেশে’ গানেই আরোগ্য খোঁজেন মানুষরা

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি প্রাণের টান না থাকলে এমন ঝুঁকি সত্যিই নেওয়া যায় না। শোনা যায় কোথাও খুব সামান্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর থাকলেও তার আগে এক সপ্তাহ অন্য কোনো গান গাইতেন না সন্ধ্যা। এমনকি এর জন্য সিনেমার গানের অফারও ফিরিয়ে দিতেন। তবুও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে যথেষ্ট সুযোগ দিতে পারেননি তিনি। শেষ জীবনেও তিনি বলেছিলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আরও কয়েকটা লং প্লেইং ডিস্ক রেকর্ড করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। সেই ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি।

তথ্যসূত্রঃ
১. সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার, অল ইন্ডিয়া রেডিও
২. ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের সান্নিধ্যে, শৌনক গুপ্ত, ইরাবতী

Powered by Froala Editor

Latest News See More