শুধু হিন্দিই নয়, বাংলা গানকেও নতুন মোড় দিয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী

সত্তরের দশকের একদম শেষের দিক। ক্রমশ বাংলার চলচ্চিত্রজগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন আরডি বর্মণ। ঠিক এমন একটা সময়েই এক তরুণ সঙ্গীত পরিচালকের কাঁধে ভার পড়ল উত্তমকুমারের ছবিতে সুরারোপ করার। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে বাপ্পি লাহিড়ীকে নিয়েই। ১৯৮১ সালে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির হাত ধরেই বাংলার চলচ্চিত্রের জগতে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিষেক বাপ্পি লাহিড়ীর। অবশ্য তাঁর প্রায় এক দশক আগেই বাংলা ছায়াছবি ‘দাদু’-তে একটি গান গাইয়ে ফেলেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। বলিউডে তাঁর খ্যাতি রীতিমতো। কিন্তু উত্তমকুমারের সিনেমাকে আদৌ কি তাঁর গান নতুন মাত্রা এনে দেবে? সংশয় প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই।

হ্যাঁ, পেরেছিল। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ শুধু বক্স-অফিস হিট করেনি, ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তার প্রতিটি গানই। কিন্তু এখানেই ‘পরীক্ষা’ শেষ হয়নি বাপ্পি লাহিড়ীর। বরং, সেটাই ছিল চ্যালেঞ্জের শুরু। হঠাৎ করেই থমকে যায় বাংলা চলচ্চিত্রের ‘উত্তমযুগ’। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-র শ্যুটিং চলাকালীন প্রয়াত হন উত্তমকুমার। প্রসেনজিৎ কিংবা তাপস পালের মতো এক ঝাঁক তরুণ-তুর্কি অভিনেতা উঠে এলেও, শূন্যস্থান রয়েই যায় বাংলা চলচ্চিত্রজগতে। সঙ্গীতের বাঁক বদল করেই বাংলা চলচ্চিত্রের সেই ক্ষতস্থান যেন বুজিয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। 

‘অমরসঙ্গী’-ই হোক কিংবা ‘গুরুদক্ষিণা’— উত্তমোত্তর যুগে বাংলা চলচ্চিত্র ‘হিট’ হওয়ার পিছনে গানের অবদান অস্বীকার করার জায়গা নেই কোনো। স্রেফ গানের মধ্যে দিয়েই দর্শকদের মন জয় করেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। দর্শকদের ফিরিয়েছিলেন প্রেক্ষাগৃহে। চার দশক পেরিয়ে আসার পর আজও বাংলার বুকে উৎসব হাজির হলেই টের পাওয়া যায় সেইসব গানের প্রভাব। বলতে গেলে চলচ্চিত্রের গানের জগতে এক নতুন ধারার সূত্রপাত করেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। বাকিটা ইতিহাস। ‘এ জীবনে পেয়েছি’, ‘ইমন বলো বসন্ত বলো’, ‘মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে’, ‘বালিতে তোমার নাম’, ‘আজ এই দিনটাকে’, ‘উরি উরি বাবা’-র মতো একের পর এক গান দিয়েছেন বাংলাকে। তাছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রে ইলেকট্রনিক মিউজিকের ব্যবহার, তা সত্যিই কি ভাবা যেত বাপ্পি লাহিড়ীর আগে? বোধ হয় না। বাপ্পি লাহিড়ীকে বাংলা ‘আইটেম সং’-এর পথিকৃৎ বললেও ভুল হয় না খুব একটা। 

তবে শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের গানকেই নয়। বাংলার সুরকেও গোটা ভারতের কাছে তুলে ধরেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘শরাবি’ ছবিটির কথাই ধরা যাক। ‘দে দে প্যায়ার দে’ গানটিতে অদ্ভুতরকমভাবেই লুকিয়ে রয়েছে উত্তরবঙ্গীয় গানের সুর। বাপ্পি লাহিড়ী নিজেও সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, হিন্দি ভাষায় ততটাও সড়োগড়ো নন তিনি। বরং, বাংলার সুর, কথার টান এবং উচ্চারণের আঙ্গিকেই গান বাঁধেন তিনি। তামাম বলিউডি গানের মধ্যেও থেকে যায় পাহাড়ি সুরের ছাপ। সবমিলিয়ে বলিউড তাঁকে ফেম দিলেও, বাংলার সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগ ছিন্ন হয়নি কখনোই।

আরও পড়ুন
হেমন্ত-সন্ধ্যা— বাংলা গানের কিংবদন্তি জুটির নেপথ্যকথন : ১

বাপ্পি লাহিড়ীর গানের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সহজ-সরল সুরের দোলা। সহজ কথামালার বুনন। আর সেই কারণেই হয়তো, কোনো বিশেষ শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল তাঁর গান। আর সেই সুরের মধ্যেই দিয়েই আজীবন বাঙালির মধ্যে বেঁচে থাকবেন তিনি…

আরও পড়ুন
ভেঙেছিল সুষুম্নাকাণ্ড, প্রযুক্তির দৌলতে চলচ্ছক্তি ফিরে পেলেন ব্রিটিশ ব্যক্তি

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘এক বেলার মধ্যেই ফুরিয়েছিল সন্ধ্যাদির অনুষ্ঠানের সমস্ত টিকিট’