মাইকেলের সনেটে সুর দিলেন সলিল চৌধুরী, গাইলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

পঞ্চাশের দশক। আকাশবাণীর অফিসের ভেতর অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন পঙ্কজ মল্লিক। এ কেমন করে সম্ভব? এতদিন তাঁর এই বিশেষ অনুষ্ঠানে গান গেয়ে এসেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতের নয়নের মণি তিনি। ঘনঘন যাতায়াত চলছে কলকাতা আর বম্বের মধ্যে। আর সেটাই ঘটল আকাশবাণীর এই বিশেষ অনুষ্ঠানের মাঝে। বম্বে থেকে ডাক পেয়ে হঠাৎই চলে গেলেন হেমন্ত। এবার উপায়? কে গাইবে ওই গান? নানা চিন্তার মধ্যে ডুবে আছেন পঙ্কজ মল্লিক। হঠাৎই বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়। মনে পড়ল রেডিওতেই গান গাওয়া এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর কথা। হেমন্ত’র মতোই ভরাট, পুরুষালি গলা। তার মধ্যেও নিজস্ব ছাপ রয়েছে। পঙ্কজ মল্লিক ডেকে নিলেন তাঁকে। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র অনুষ্ঠানে উঠে এলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়; তাঁর কণ্ঠে বেজে উঠল ‘জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিণী’…

বাকিটা ইতিহাস। বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া একটা রেডিও অনুষ্ঠান। আর সেই অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠে এসেছিলেন যিনি, তাঁকে কি ভোলা যায়? ‘জাগো দুর্গা’র সঙ্গে যে আমাদেরও ঘুম ভাঙে মহালয়ার ভোরে। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় এইভাবেই কখন যে মিশে গেছেন বাংলার সঙ্গে, বোঝাই যায়নি! তিনি কিংবদন্তি, তাঁর গলার সামনে নতজানু হয়ে বসে থাকতে হয়। পরবর্তীকালে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে দ্বিজেনের গাওয়া সেই বিশেষ গানটি শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও।

অবশ্য কেবলমাত্র ‘জাগো দুর্গা’র জন্যই যে অমরত্ব পেয়েছেন দ্বিজেনবাবু, সেটা বলা যায় না। তাঁর যাতায়াতের রাস্তাটি যে বহুধাবিস্তৃত। সঙ্গীতের নানা জগত ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি। অদ্ভুত ব্যাপার, ছোটোবেলায় নাকি এই গান ব্যাপারটাকেই পছন্দ করতেন না। বনেদি পরিবারে জন্ম; সোনার চামচ মুখে দিয়ে না জন্মালেও অবস্থা বেশ ভালোই ছিল। আর ছোট্ট দ্বিজেন ঘুরে বেরিয়েছেন মাঠে-ময়দানে। তাঁর তখন শখ ছিল ফুটবল। আর গান? সে তো মেয়েদের বিনোদনের অঙ্গ। ছেলেরা সেসব করবে কেন? হারমোনিয়ামের দিকেই ঘেঁষলেন না দ্বিজেন… 

এমন ছেলেই যে বাংলার সঙ্গীতজগতের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হয়ে উঠবেন, সেটা কেউ ভেবেছিল! ক্লাসে বেঞ্চ বাজিয়ে গান করছিলেন তিনি। স্কুলের বন্ধুবান্ধবরা জোর করে দ্বিজেনের নাম ঢুকিয়ে দিল একটি গানের অনুষ্ঠানে। ব্যস, এবার যায় কোথায়! অনুষ্ঠানে নাম যখন গেছে, তখন একটু তো রেওয়াজ করতেই হবে। বলা ভালো, তখন থেকেই শুরু পথ চলা। সেই অনুষ্ঠান থেকে গুরু হিসেবে পাওয়া সুশান্ত লাহিড়ীকে। ভারী জলদগম্ভীর গলা; ঠিক যেন হেমন্ত’র মতো। স্বয়ং দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ও চলার পথে অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তাঁকে। হেমন্ত’র মতোই হাতা গোটানো সাদা শার্ট আর ধুতি পরতেন। বিশ্বাস ছিল নিজের প্রতিভার ওপর, নিজের সাধনার ওপর।

চল্লিশের দশকের শেষ দিকে সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’। পরে ‘রানার’, ‘পালকির গান’… সলিল-হেমন্ত জুটি তখন রীতিমতো বিখ্যাত। ততদিনে আইপিটিএ-তে যোগ দিয়েছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ও। আর সেখানেই আলাপ সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। ‘আপনি’ থেকে ‘তুই’-তে যেতে সময় লাগেনি বেশি। দ্বিজেনের গানের ধরণ, তাঁর গলা আকৃষ্ট করল সলিলকে। হেমন্ত’র সেই গানের পরই তৈরি করলেন ‘শ্যামল বরণী ওগো কন্যা’। আর সেই সুরেই গলা মেলালেন দ্বিজেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, এই গানটিও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই গেয়েছেন। এরকম দরাজ, ভারী গলা আর কার হবে! কিন্তু আসল সত্য সামনে আসার পরই অবাক হয়েছেন তাঁরা। তাহলে হেমন্তের উত্তরসূরিও দেখে ফেলল বাংলা! 

এমন সময় আরও একটি সাহসী কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সলিল চৌধুরী। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সুর তো দিয়েছিলেনই। এবার একটু অন্যরকম কিছু করার পালা। সলিলের নজরে এলেন মধুকবি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা ভাষাকে এক ধাক্কায় কয়েক গজ এগিয়ে দিয়েছিলেন মাইকেল। এই ভাষাতেও যে সনেট লেখা যায়, সেটা তিনি না থাকলে আর কে দেখাতেন! সলিল চৌধুরী এই সনেট বা ‘চতুর্দশপদী কবিতা’গুলোর দিকে চোখ ফেরালেন। আচ্ছা, এগুলোকে যদি সুর দেওয়া যায়, কেমন হবে? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ‘রেখো মা দাসেরে মনে’, ‘আশার ছলনে ভুলি’র মতো সনেটে সুর দিলেন তিনি। আর গাইলেন দ্বিকেন মুখোপাধ্যায়। আবারও ইতিহাস তৈরি হল সঙ্গীত জগতে…  

আরও পড়ুন
অপরিচিত কণ্ঠে হঠাৎ গুনগুন, চলন্ত ট্রামেই নিজের গান শুনতে পেলেন আব্বাসউদ্দিন

সলিল চৌধুরীর সৌজন্যেই বাংলা ও হিন্দি ছবিতে গান করেন দ্বিজেন। তবে এতকিছুর মধ্যেও তাঁর জীবনে আরেকজন মানুষ জায়গা করে নেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রেডিওতে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় নিজের যাত্রা শুরু করেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাত ধরেই। ভরা গলায়, তন্ময় হয়ে, স্বরলিপি মেনে ডুব দিতেন সেই জগতে। যদিও তাঁর কোনো প্রথাগত রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা ছিল। শান্তিদেব ঘোষ, সন্তোষ সেনগুপ্তের মতো মানুষদের কাছ থেকে চলার পথেই একটু একটু করে রসদ নিয়েছেন। বাকিটা ছিল নিজের চেষ্টা। দ্বিজেনের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত একটা সময় রাজ্য তো বটেই, দেশেরও গণ্ডি পেরিয়েছিল। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকেও শুনিয়েছিলেন সেই গান। জীবনের শেষলগ্নেও বারবার ছুটে গেছেন শান্তিনিকেতনে, গুরুদেবের আশ্রমে। সেখানেই শান্তি, সেখানেই পরম সৌন্দর্য… 

পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী যখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের ‘শুদ্ধতা’ বাঁচাতে আসরে নামল, তখন সেখান থেকে আমন্ত্রণ পেলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ও। বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। এর আগে আর কোনো অ-আশ্রমিক এই সুযোগ পাননি। সেদিক থেকেও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় পথিকৃৎ। দুবছর আগে তিনি চলে গেছেন। কিন্তু সে তো পার্থিব যাওয়া। বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার গান যতদিন থাকবে, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে কি অস্বীকার করা যাবে? আসছে বছর আবারও মহালয়ার ভোরে তর্পণে বেরোবে বাঙালি; আর রেডিওতে বেজে উঠবে ‘জাগো, তুমি জাগো’। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি তো আমাদের সঙ্গে আছেনই সবসময়, আছেন দ্বিজেনের সঙ্গেও… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘শ্রীদ্বিজেন মুখোপাধ্যায় (১৯২৭-২০১৮)’, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় স্মরণে’, ডেইলি ও
৩) ‘দ্বিজেনবাবু মানেই মহালয়ার গান থেকে মাইকেলের সনেট’, সরোজ দরবার, সংবাদ প্রতিদিন 

আরও পড়ুন
দুর্গার জন্য গান স্যালুট; কলকাতার ‘বন্দুকওয়ালা বাড়ি’তে অভিনব অভ্যর্থনা দেবীর

Powered by Froala Editor

More From Author See More