ফুটবল খেলতে গিয়ে চোখে আঘাত; সিনেমার জন্য দাদার কাছে চড়ও খেয়েছেন পান্নালাল

(দ্বিতীয় পর্ব)

পান্নালালের চলে যাবার পর তাঁর দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য ‘পান্নালাল স্মরণে’ রেকর্ড করেছিলেন দুটি গান - ‘থির হয়ে তুই বস দেখি মা’ এবং ‘ত্রিভুবন জয় করিয়া রাবণ’, দুটি গানই তাঁর নিজের লেখা। সুর করেছিলেন আরেক দাদা প্রফুল্ল ভট্টাচার্য্য। শোকে বিহ্বল ধনঞ্জয়ের কণ্ঠে সে গান শুনলে বুকটা হু হু করে ওঠে। একটি গানে লিখেছিলেন – 

‘মায়ের দুয়ারে যদি দেখো কেউ/গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে/আকুল কণ্ঠে গেয়ে যায় কেহ/মায়েরই অমৃত নাম।/কাছে গিয়ে তাঁর হাত দু’টি ধরে/জেনে নিও দুটি কথা/কেমন আছে সে? কোথায় আছে সে?/কিবা সে দেশেরই নাম ।।’

অন্য গানের কথাগুলি শুনলে গায়ে কাঁটা দেয় – ‘সত্যি করে বল পাষাণী/রাখলি কোথা তাঁকে?/মুণ্ডমালায় গাঁথলি নাকি/কটিবাসের পাকে।/মা হয়ে তুই রক্ত খাবি/হলি কালের কাল/পান্নাকে তুই খেয়েছিস তাই/হাতে মুখে লাল/তোকে খেয়ে শোধ নোব মা/নাচব তা থৈ থৈ ।।’
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
কী সন্দেহে ধনঞ্জয় লিখলেন এমন কথা? শিহরণ জাগে যখন মনে পড়ে পান্নালালের শেষ স্টুডিও রেকর্ডিং-এর গান দুটির মধ্যে একটি ছিল অসিতকুমার বসুর লেখা ‘ওদের মতো বলব না মা’। সেখানেই তো পান্নালাল গেয়েছিলেন – ‘আমার মুণ্ড মা তোর মালায় র’বে/দু’হাত হ’বে কটি বাস/সেই মুখেতে বলব ‘মা’ ‘মা’/সে’হাতে তুই অর্ঘ্য চাস…’ 

এই গান বোধহয় একমাত্র পান্নালালের পক্ষেই গাওয়া সম্ভব! 

পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত গাইবার শুরু কিন্তু যুবক বয়সে নয়, একেবারে শিশুবেলায়। তাঁর ছোড়দি সরস্বতী ভট্টাচার্য্যের কলমে শিশু পান্নালালের কথা কিছু পাই –

আরও পড়ুন
প্রায়ই সময় কাটাতেন শ্মশানে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই গলায় দড়ি দিলেন পান্নালাল

‘পানুর মুখে যখন ‘আধো আধো বোল’ তখন থেকেই সে আমাদের সঙ্গে মায়ের গান গাইত। কিন্তু কী আশ্চর্য – অতটুকু ছেলের কোনো সুরচ্যুতি নেই। সেও যেন আমাদের থেকে মেজদার (ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য) মতই আলাদা। ছোট থেকেই পানু অসম্ভব ডাকাবুকো দুরন্ত ছিল আর তার সঙ্গে ছিল তার দুষ্টুমি বুদ্ধি। পানুর দৌরাত্ম্যের অভিযোগ শুনতে শুনতে অতিষ্ট হয়ে মা তাঁর দুই ছেলেকে পানুর জন্য কিছু করতে বললে মেজদা তাঁকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে পাঠান।’

মনে পড়ে, কুমার শম্ভুচন্দ্র রায়ের লেখা একটি পদে ভোলানাথ বিশ্বাসের সুরে আকাশবাণীতে পান্নালাল গেয়েছিলেন – ‘সন্তানে দৌরাত্ম্য করে সইতে হয় সব জননীরে / মন্দ বলে কোলে করে ফেলে দিতে পারে না…’। মা তাঁর সন্তানের অন্য পথ বোধহয় আগেই বেছে রেখেছিলেন। 

জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে কদিন শেখার পর তেমন আগ্রহ না দেখে তাঁকে যামিনী গাঙ্গুলির কাছে পাঠান মেজদা। সেখানেও তিনি সঙ্গীতশিক্ষা শেষ করতে না পারায় শেষমেশ নিজেই সেখাতে থাকেন তাঁকে। 

আরও পড়ুন
পান্নালাল ভট্টাচার্যকেও রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলিয়েছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়

গানের পাশাপাশি পান্নালালের নেশা ছিল রান্নাকরা, মাছধরা, ঘুড়ি ওড়ানো আর ফুটবল খেলা। মাছধরার নেশা অবশ্য ধনঞ্জয়েরও ছিল তেমনই। অনেক বাড়ি থেকে তাঁদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হত বাড়ির পুকুরে অনেক বড়ো বড় মাছ আছে এই বলে। গিয়ে হয়ত দেখা গেল নামমাত্র পুকুর। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য থাকত ধনঞ্জয়-পান্নালালকে বাড়িতে এনে গান গাইয়ে লোক দেখানো। অনেকেই ঠকিয়েছে এইভাবে। 

ফুটবল বলতে অজ্ঞান পান্নালাল ভীষণ ভক্ত ছিলেন মোহনবাগানের। আবার একটু রাগও ছিল ক্লাবের ওপর শৈলেন মান্না ক্লাবের মেম্বারশিপ দেননি বলে। মোহনবাগানের সমর (বদ্রু) বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবলের অধিনায়ক নির্ধারিত হয়েছিলেন বালির কৃতী ছেলে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে মেজদার নির্দেশ মেনে বালিতে নিয়ে এসেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম নক্ষত্র পি. কে. ব্যানার্জীকে। 

আবার ১৭-১৮ বছর বয়সে এই ফুটবল খেলতে গিয়েই ঘটে গিয়েছিল এক মারাত্মক দুর্ঘটনা! 

আরও পড়ুন
বাঁশির জাদুতে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি, ‘বঙ্গাল কা শের’ পান্নালালকে কি মনে রেখেছি আমরা?

বালির বারেন্দ্র পাড়ায় একটি বড়ো মাঠ ছিল। সেখানে খেলতে গিয়েছিলেন পান্নালাল। একটি বল সজোরে লাগে তাঁর চোখে। ভর্তি করা হয় স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানে কিছু করা সম্ভব নয় জেনে ধনঞ্জয় ভাইকে কলকাতায় এনে ভর্তি করেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ডাক্তারদের আশঙ্কা ছিল চোখ দুটি বোধহয় নষ্টই হয়ে যাবে। শেষে দেড় মাস হাসপাতালে ভর্তি থেকে ৪৫০ টাকা দামের ২৫টি ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর তাঁর চোখ বেঁচে যায়। তবে ডান চোখের মণিটি সামান্য সরে যায়। মেজদা ও বৌদির সেবায় তিনি সম্পূর্ণ সেরে ওঠেন। তারপর থেকেই বৌদিকে মাতৃজ্ঞান করতেন পান্নালাল। 

সরস্বতী পুজোর সময় তাঁর ঘুড়ি ওড়ানো ছিল দেখবার মতন। নামডাক হবার পরেও এ নিয়মের অন্যথা ঘটত না। 

আগেই বলেছি শ্যামাসঙ্গীত নয়, পান্নালালের প্রথম রেকর্ড আধুনিক গানের। আরো একটি রেকর্ড করার পর যখন দাদা শ্যামাসঙ্গীত গাইতে বললেন তখন একটু অভিমান হয়েছিল তাঁর। কেউ কেউ হয়তো ভুল বুঝিয়েছিল যে তোর দাদা নিজের জায়গাটা তোকে দিতে চাইছে না। তাই কয়েকবছরের জন্য বেশ দূরত্ব তৈরি হয়েছিল ভায়েদের মধ্যে। পরে অবশ্য তা মিটে যায়। 

শুধু আধুনিক গানই নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীতও গেয়েছিলেন পান্নালাল। একদিন স্বয়ং উপস্থিত হলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মরমী শিল্পী চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। বললেন, আমি একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইব, আপনি তুলে দিন। খুব সম্ভবত কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে গাইবার জন্যে তুলতে চাইছিলেন একটি রবীন্দ্রগান। চিন্ময় সব শুনে বললেন, আপনার গলায় ঐ গানটা খুব ভালো মানাবে – ‘ভালো যদি বাস, সখী, কি দিব গো আর’। কথামতন গানটি পান্নালালকে তুলিয়ে দেন চিন্ময়। 

নজরুলের গান তো রেকর্ডও করেছেন। তাঁর গাওয়া ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ কে ভুলতে পারে?

গান লিখেওছেন পান্নালাল! শ্রীঅভয় ছদ্মনামে লিখেছিলেন ‘তোর মত মা এত আপন কি আর শ্যামা আমার আছে/তুই যদি মা মুখ ফিরাবি যাব তবে কাহার কাছে? …’ সুর করে গেয়েছিলেন নিজেই। শুনলে মনে হয় যেন ছোট্ট শিশুটির আবদার তাঁর মায়ের কাছে! 

‘লক্ষ্মীনারায়ণ’, ‘মা ছিন্নমস্তা’, ‘মাথুর’, ‘পাগল ঠাকুর’ ইত্যাদি ছায়াছবিতেও তাঁর গান শোনা যায়। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে অভিনয় করার জন্য খুব উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। তাঁর তিন বন্ধু সনৎ সিংহ, শ্যামল মিত্র এবং মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় অভিনয় করবেন তাতে। মায়ের কাছে অনুমতি নিতে গেলে মা বললেন, ধনাকে জিজ্ঞেস কর। মেজদার কাছে বলতে সোজা ‘না’ করে দিলেন। অত্যধিক পীড়াপীড়ি করতে মারলেন এক চড়! কিন্তু ওই শেষবার, আর কখনও ভাইয়ের গায়ে হাত তোলেননি ধনঞ্জয়। পরবর্তীতে বিশ্বরূপা থিয়েটারে একটি নাটকে তিনি অভিনয় করেছিলেন বলে শোনা যায়।

খামখেয়ালি, বাউন্ডুলে পান্নালাল আবার ছিলেন খুব সংসারী মানুষ। ১৯৫৪ সালের ১৪ মার্চ মঞ্জুশ্রী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁর তিন মেয়ে – কাজরী, কাকলি ও শর্বরী। মেয়েদের জামা কেনাকাটা থেকে চুল বেঁধে দেওয়া, আবার মাঝেমধ্যে রান্নার জন্য কুটনো কেটে দেওয়া – ইত্যাদি কাজ নিজেই করতেন। সেই পান্নালালই হঠাৎ করে হয়ে পড়লেন মায়ের নামে বিভোর। 

তখন তাঁর জীবনের একটাই আশা, মায়ের দেখা পাওয়া। 

মা স্বয়ং স্বপ্নে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্যকে বলেছিলেন মাছ খাওয়াতে। মাকে ভোগ দিয়ে খাইয়েছিলেন তিনি। এরকম হয়েছিল আরো কয়েকবার। সেই দেখে পান্নালাল ভাবতেন খালি মায়ের কথা। শ্মশানে বসে একাকী চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলতেন, সারাজীবন তোর গান গাইলাম, তবু আমায় দেখা দিলি না? সেই ভাবনাই পরিস্ফুট হয়ে উঠত তাঁর গাওয়া গানে। 

শেষে জীবনের অন্তিম পথ বেছে নিলেন তিনি। সঙ্গীতজগতের একটি তারা হঠাৎ করেই খসে পড়ল! 

পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন হয় না বোধহয়। অতি বড় নাস্তিকও অশ্রুমোচন করেছেন তাঁর গান শুনে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান সঙ্গীতব্যক্তিত্ব হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘খুবই মিষ্টি গান করত পান্নালাল। খুব ভালো। তবে ও যে খুব বড় শ্রেণীর গায়ক এটা পরের দিকে ওর রেকর্ড শুনে বেশি করে বুঝতে পারলাম। তার কারণ ও যখন গাইছে তখন ওর গান বেশি করে শোনা হয়নি। পরে যখন বেশি করে শুনলাম, বুঝলাম।’ 

তাঁর গানেই অমর হয়ে গেলেন পান্নালাল। অর্ধশতাব্দীকাল পরেও শ্যামাসঙ্গীতে তাঁর নামটাই সবার আগে মনে আসে শ্রোতাদের। এইখানেই তিনি চিরন্তন। 

(সমাপ্ত)

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

তথ্যসূত্রঃ
৪) উপালি মুখার্জির নেওয়া দীপঙ্কর ভট্টাচার্য্যের সাক্ষাৎকার (২৭ অক্টোবর, ২০১৯, এন.ডি.টি.ভি. বাংলায় প্রকাশিত)
৫) ‘আমার গানের স্বরলিপি’/ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (এ মুখার্জী এ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ – বইমেলা, ১৯৮৮)
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ বীরেন চট্টোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু দে, সপ্তর্ষি ঘটক

Powered by Froala Editor

More From Author See More