শহরজুড়ে দাঙ্গা; কলিম শরাফীকে লুকিয়ে রাখলেন দেবব্রত বিশ্বাস, জানতে দেননি হেমন্তকেও

তখন রাত একটা। অল্পবয়সী একটি ছেলে একতলার ঘরে মৃদু বাতির আলোয় নিভৃতে রেডিও শুনছে। একটি বেসরকারী রেডিও চ্যানেলে (অধুনালুপ্ত) বাজানো হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত। অবসন্ন বালকটি কবিতা না-লিখতে পারার বালকোচিত দুঃখে বিভোর তখন। হঠাৎ ঘোষণা হল, ‘এইবার দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া দুইখানি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে বিদায় নিচ্ছি আমি আর.জে. অমুক’। অল্প প্রিলিউডের পর শুরু হল গান। ‘দীপ নিবে গেছে মম নিশীথসমীরে…’। জলদমন্দ্র-কণ্ঠে প্রাণের সবটুকু আবেগঢালা এক আত্মমগ্ন পরিবেশনা। ঐটুকু বয়সেও বালকটি এক মনে শুনতে থাকে গানের কথাগুলো। যেন তাকে শিল্পী বলছেন শিল্পী-জীবনের শেষ বেদনার মূল স্বরূপ! ‘ভয় পাছে শেষ রাতে ঘুম আসে আঁখিপাতে / ক্লান্ত কণ্ঠে মোর সুর ফুরায় যদি রে’ – শুধু গাইয়ে নয়, সব শিল্পীর জীবনেই বোধহয় এটিই একমাত্র বুক-কাঁপানো আশঙ্কা! তবে এর ঠিক আগেই কিন্তু শিল্পীর আত্মাভিমানটুকুও নজর এড়ায় না - ‘এ পথে যখন যাবে আঁধারে চিনিতে পাবে / রজনীগন্ধার গন্ধ ভরেছে মন্দিরে’। সেদিনের সেই বালকই আজকের এই লেখক।

সেদিন রাতে সেই শিল্পীর কণ্ঠে এই গান বালকমনে গভীর রেখাপাত করেছিল। এ-গানটি রেকর্ড করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও। ঘটনাচক্রে পরবর্তীকালে সেই বালক অসম্ভব হেমন্ত-অনুরাগী হয়ে পড়লেও এই একটিমাত্র গান প্রাণে ধরে তার প্রিয় শিল্পীকে সে দিয়ে উঠতে পারেনি! চোখ বন্ধ করলে সে এখনও গানটি শুনতে পায় সেই জলদমন্দ্র গভীর কণ্ঠস্বরে, অচিরেই ভিজে ওঠে তার চোখের কোল। সেই কণ্ঠের অধিকারী হলেন দেবব্রত বিশ্বাস, বাঙালী যাঁকে এক ডাকে চেনে ‘জর্জ বিশ্বাস’ বা ‘জর্জদা’ নামে।

১৯১১ সালের ২২ অগাস্ট বরিশালে দাদুর বাড়িতে দেবব্রত বিশ্বাসের জন্ম। তাঁর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম। ১৯২৭ সালের শেষের দিকে অথবা ’২৮ সালের গোড়ার দিকে দেবব্রত বিশ্বাস কলকাতায় আসেন এবং আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজে ভর্তি হন। তারপর ’৩৩ এ ইকোনমিক্সে এম এ পাশ এবং ’৩৪ সালে হিন্দুস্তান ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে কেরানিজীবন শুরু। তখন থাকতেন ভবানীপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে। তারপর অনেকবার বাড়ি পাল্টেছেন। ’৩৮ সালে বাবা মারা যাবার পর ছোট বোন ও মাকে নিয়ে বালিগঞ্জের কবীর রোডের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করেন। দেবব্রত বিশ্বাসের কলকাতায় আসার বছর দুয়েকের মধ্যেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সপরিবারে কলকাতায় এসেছিলেন ’২৯ বা ’৩০ সাল নাগাদ। ১৯৩৮ সালেই দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম আলাপ হয় বঙ্গসংস্কৃতির রেনেসাঁয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর তিনজন কাছের বন্ধু অজিত চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ রায় এবং পরিমল সেনের সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের আলাপ সেই সময়ই। তারপর থেকেই একসাথে গণনাট্য সংঘের ঐতিহাসিক দিনগুলি কাটাতে শুরু করেন হেমন্ত-দেবব্রত এবং দেবব্রত বিশ্বাসের প্রয়াণের দিন পর্যন্ত এই সম্পর্ক ছিল অটুট।

তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। সেইসময়ে মারামারি, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, কালোবাজারি ইত্যাদির মধ্যে সম্প্রীতির বার্তা ও গণতান্ত্রিক মানবাধিকার নিয়ে নবজাগরণ গড়ে তুলতে গঠিত হল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (আইপিটিএ)। সেখানে দেবব্রত বিশ্বাস ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, খালেদ চৌধুরী, সলিল চৌধুরী, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ যোগ দিলেন একে একে। বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতে লাগলেন আইপিটিএ’র গান। তখন সলিল চৌধুরীর লেখা গান, হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গান, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র’র ‘নবজীবনের গান’ দুজনেই গাইতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

আরও পড়ুন
সুপ্রিয়ার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে; ঋত্বিক ঘটককে শর্ত দিলেন দেবব্রত বিশ্বাস

১৯৪২ সালে দেবব্রত বিশ্বাস উঠে এলেন ১৭৪ই রাসবিহারী এভিন্যু’র ভাড়া বাড়িতে। তখন থেকেই প্রত্যেকদিন সন্ধ্যেবেলা তাঁর বাড়িতে বসত সান্ধ্য আড্ডা। আড্ডায় থাকতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও তাঁর বন্ধুবান্ধবরা এবং অনেকে। নির্ভেজাল আড্ডা, গান, রসিকতায় কাটত দিনগুলি। আবার দুর্দিন এল ১৯৪৬ সালে। অগাস্ট মাস থেকে শুরু হল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ভয়াবহ দিনগুলি। হিন্দু-মুসলিম তখন পরস্পরের জাতশত্রু। লাশ পড়ছে হামেশাই। সেই সময়ের একটি ঘটনা বলি।

এক বৃষ্টির দিনে কলিম শরাফী (পরবর্তীকালে ওপার বাংলার জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী) নামলেন হাওড়া স্টেশনে। শুনশান এলাকার চারদিকে চোখ ফেরাতেই দেখলেন একটি লাশ। বিপুল আতঙ্কে লুকিয়ে লুকিয়ে পৌঁছলেন জর্জ বিশ্বাসের বাড়িতে। তাঁকে দেখেই জর্জ সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করলেন এবং তাঁকে চালান করলেন খাটের তলায়। কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না মুসলিম কলিম শরাফী রয়েছে তাঁর বাড়িতে। জানাজানি হলে হিন্দু অধ্যুষিত সেই অঞ্চলে কলিম লাশ হয়ে উঠতে পারেন!

আরও পড়ুন
‘তোমার স্টাইলে গানটা রেকর্ড করলাম’ – চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে লিখে দিয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস

কদিন পরেই জর্জ বিশ্বাসের বাড়িতে কৌতূহলী টোকা পড়ল। সতর্ক হয়ে উঠলেন ঘরের ভেতরের দুজন। কলিম বিছানার তলায় ঢুকে পড়ার পর জর্জ গিয়ে দরজা ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রতিদিনের উন্মুক্ত দ্বার পুরো খুললেন না জর্জ। তাই দেখে হেমন্ত সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন উৎকণ্ঠিতভাবে, ‘জর্জদা, কলিমটার খোঁজ পাচ্ছি না অনেকদিন। খুব চিন্তা হচ্ছে, চারিদিকে যা হচ্ছে। আপনার এখানে কি এসেছিল?’ নির্লিপ্তভাবে জর্জ বললেন, ‘আমার এহানে আইব, পাগল হৈছস! দেখ হয়ত মইরা গেছে গিয়া’। এমন উত্তর ভাবিত হেমন্তর হজম হল না। তবুও চলে গেলেন সেদিন তিনি। অবস্থার সামান্য উন্নতি হবার পর জর্জ একদিন কলিমের মাথায় একটি গান্ধী টুপি পরিয়ে কমরেড মুজাফফর আহমেদের কাছে দিয়ে এলেন। সেযাত্রা কলিম রক্ষা পেলেন। জর্জ বিশ্বাসের এই মহানুভবতার কথা হেমন্ত উল্লেখ করেছেন বহুবার।

এরপরে সেই সান্ধ্য আড্ডা আবার চালু হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হল।

সেইসময় দেবব্রত অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে ‘গীতবিতান’ থেকে ‘রক্তকরবী’ নাটক মঞ্চস্থ হয় দুইদিন ধরে ‘কালিকা’ সিনেমা হলে। সেখানে বিশুপাগলের চরিত্রে অভিনয় ও গান করেছিলেন দেবব্রত। এর ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ’৪৮-এ হেমেন গুপ্তর পরিচালনায় ‘ভুলি নাই’ ছায়াছবিতে অভিনয় করলেন দেবব্রত। গাইলেন দুইখানি গান ‘সাবধান সাবধান’ এবং ‘অজ্ঞানতম বিদূরকারিণী’। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সমবেত কণ্ঠেও রইলেন তিনি এবং ছবির সহকারী সঙ্গীত পরিচালক সমরেশ রায়। হেমন্তর সুরে জর্জ বিশ্বাসের প্রথম কণ্ঠদান এবং চলচ্চিত্রে অভিনয় – এই দুয়ে মিলে ‘ভুলি নাই’ ছবিটির ঐতিহাসিক মূল্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এরপরেও হেমন্তর সুরে দেবব্রত বেশ কয়েকটি ছবিতে গান করেছেন। সে’কথায় পরে আসছি।

আইপিটিএ-তেই সলিল চৌধুরী কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা ‘অবাক পৃথিবী’ গানে সুর করেন। সেই গান দেবব্রত মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। রেকর্ড করার কথা হলে দেবব্রত হেমন্তকে দিয়ে রেকর্ড করানোর পক্ষেই সায় দেন। ১৯৫০ সালে হেমন্ত রেকর্ডের দুই পিঠ জুড়ে রেকর্ড করেন সেই গান। তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে গানটি। অনেক পরে কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তকে হেমন্ত বলেছিলেন, ‘অবাক পৃথিবী’ জর্জকাকা আমার চাইতে ভালো গাইতেন। আমি যদি গানটা দশ-বারোবার রেকর্ড করতাম, তবুও জর্জকাকা যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন তা পারতাম না’। সত্যি এক শিল্পীর প্রতি আরেক শিল্পীর এই সম্মান প্রদর্শন ভাবা যায় না! পরবর্তীতে আইপিটিএ’র আরও কয়েকটি গান যেগুলি জর্জ বিশ্বাস গাইতেন সেগুলো সলিল রেকর্ড করিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে। 

আরও পড়ুন
হেমন্ত যদি চিনা খবরের কাগজও সুর করে পড়ে, লোকে শুনবে - বলেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস

Powered by Froala Editor

More From Author See More