‘তোমার স্টাইলে গানটা রেকর্ড করলাম’ – চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে লিখে দিয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস

সালটা ১৯৮৩। বন্যাত্রাণের জন্য সরকার সাতদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করাচ্ছে রবীন্দ্রসদনে। সেই অনুষ্ঠানের একদিনের ঘটনা। সেদিন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে দুই অর্ধে। প্রথম ভাগে গাইবেন পুরুষশিল্পীরা এবং মহিলাশিল্পীরা গাইবেন দ্বিতীয় ভাগে। শুরু হল অনুষ্ঠান। প্রথমে গাইলেন সেসময়ের জনপ্রিয় শিল্পী হিমঘ্ন রায় চৌধুরী। গান গেয়ে চলে গেলেন তিনি। তিনি থাকতেন রবীন্দ্রসদনের কাছেই। এরপরে ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ এবং আরো অনেকে। প্রথমার্ধে সব শেষে গাইতে এলেন একজন সৌম্যদর্শন শিল্পী। বিরহসিক্ত কণ্ঠে একের একের পর এক গাইতে লাগলেন ‘জানি তুমি ফিরে আসিবে আবার’, ‘বাণী মোর নাহি’, ‘হায় গো, ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়’, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’। দুই-তিন দিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতজগতের আর এক স্মরণীয় শিল্পী সাগর সেন। যদিও সেটি ‘সাগর সেন স্মরণ অনুষ্ঠান’ ছিল না, তবু শ্রোতারা বুঝতে পারলেন এই নিবেদন এক সহশিল্পীর চলে যাওয়ার বেদনারই অনুরণন।

প্রথমার্ধের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর অবগুন্ঠনাবৃত হল মঞ্চ। বিরতির পর শ্রোতারা অপেক্ষা করতে লাগলেন অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য। কিন্তু পর্দা আর সরে না। স্বাভাবিকভাবেই উশখুশ করতে থাকা স্রোতাদের মধ্যে শুরু হল গুঞ্জন। রবীন্দ্রসদনে তো এমনটা কখনও হয় না। অসীম কৌতূহলের মাঝে হঠাৎ মঞ্চের সামনে থেকে পর্দা সরে গেল। দেখা গেলো শান্তিদেব ঘোষ, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ সেই অনুষ্ঠানের সব শিল্পী নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এবার পূর্বোক্ত সৌম্যদর্শন শিল্পী মাইক্রোফোনের সামনে এগিয়ে এসে কান্না-জড়িত কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলেন – ‘একটু আগেই যে শিল্পী আপনাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করে গেলেন, সেই শিল্পী হিমঘ্ন রায় চৌধুরী আর আমাদের মধ্যে নেই’। আসলে গান গেয়ে বেরিয়ে আসার পরই হার্ট এট্যাক হয় হিমঘ্নবাবুর, এবং তিনি মারা যান। সেদিনের অনুষ্ঠান সেখানেই স্থগিত রাখা হয়। মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে সৌম্যকান্তি সেই শিল্পী এবং আরও অনেকে মিলে হেঁটে গেলেন পি জি হাসপাতালে প্রয়াত শিল্পীর উদ্দেশে। সহশিল্পীদের প্রতি এহেন সহমর্মিতার নিদর্শন আজকের যুগে বিরল।

সেই সুদর্শন শিল্পী হলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভুবনে পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে পঙ্কজ-হেমন্ত-জর্জ বিশ্বাসের ঐতিহ্যের একজন ডায়নামিক ধারক, বাহক এবং উত্তরসূরী। সত্যিই, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা জর্জ বিশ্বাসের পাশপাশি এমন উজ্জ্বল অস্তিত্ব বজায় রেখে এমন জনপ্রিয়তা লাভ করা সেসময়ে চাট্টিখানি কথা ছিল না! এইরকম একজন শিল্পীর জীবন কালের ঘায়েই হয়ত বা অনালোচিত রয়ে গেছে। আজ শিল্পীর ৩৩তম প্রয়াণবার্ষিকীতে এক উজ্জ্বল অতীতচারণে তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

রবীন্দ্রসরোবর স্টেডিয়াম প্রেক্ষাগৃহে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাণ্ডারী দিনু ঠাকুরের সভায় চিন্ময় গাইছিলেন। উইংসের ধারে বসে তাঁর গান শুনছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বিশিষ্ট সঙ্গীতব্যক্তিত্ব সন্তোষ সেনগুপ্ত এবং কৃষ্ণলাল মুখোপাধ্যায়। শেষোক্ত ব্যক্তি হলেন চিন্ময়ের বাল্যবন্ধু। কলেজ জীবনে চিন্ময় যখন প্রথম আকাশবাণীতে গান গাইলেন - ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’, আশুতোষ কলেজের সামনের পানের দোকানের রেডিও থেকে ভেসে আসা চিন্ময়ের সেই গানের স্রোতা ছিলেন যেকজন বন্ধু, ইনি তাঁদেরই একজন। সন্তোষ সেনগুপ্ত চিন্ময়ের এই বন্ধুকেই গর্ব করে বলছিলেন, ‘জানো, চিন্ময় আমার আবিষ্কার?’ ‘কীরকম?’ ‘তখন চিন্ময় ছেলেমানুষ। প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্রের বাড়িতে একটা ক্লাব ছিল, সেখানে মজলিস বসত। ওদের বাড়ির ছেলেরা ছিল ওর বন্ধু। ও প্রায়ই ওখানে যেত। ওস্তাদদের গানের আসরের আনাচে কানাচে প্রায়ই লাজুক ছেলেটিকে দেখতুম। প্রতাপদা বললেন, সন্তোষ, কল্যাণী কংগ্রেসে রাধাকৃষ্ণন আসবেন, ‘ওপেনিং সং’ কে গাইবে? চিন্ময়কে বললুম, গানের আসরে আসো গান জানো। ও মাথা হেঁট করে সপ্রতিভ গলায় বলল, একটু-আধটু। ব্যস, গাইল, আর বড় ভালো লাগল সবার। যেমনি মধুর তেমনি জোয়ারিদার আওয়াজ। রেডিও গ্রামোফোন কোম্পানীতে আমার হাত ধরেই ওর প্রবেশ’।

চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘HIS MASTER'S VOICE’ এর ছাপমারা লাল রঙের ৭৮ আরপিএমের রেকর্ডটা। ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ ও ‘আজি বিজন ঘরে’। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের মাঝে বাষ্পভেজা শীতল হাওয়ার মতন এমন পরশ রবীন্দ্রসঙ্গীতে বোধহয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ব্যতীত ধরা পড়ল দ্বিতীয় একজন শিল্পীর কণ্ঠে । তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ গানটি, আজও যা রবীন্দ্রসঙ্গীতজগতে একটি মাইলফলক। সন্তোষ সেনগুপ্ত গর্ব করবেন নাই বা কেন? তবে এর আগে ১৯৪৮ সালে গানটি রেকর্ড করেছিলেন সুধীন চট্টোপাধ্যায়। চিন্ময় গানটি রেকর্ড করার আগে সুধীনবাবুর অনুমতি নিতে গেছিলেন। সেদিন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে প্রথম দেখেন কবীর সুমন। পরবর্তীতে তিনিও এই গানটি রেকর্ড করে উত্তরাধিকার সূত্রে গানটির অন্যতম দাবিদার হয়ে পড়েছেন।

এরপর ফিরে তাকাতে হয়নি চিন্ময়কে। পরের রেকর্ডেই আবার তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে। তাঁর দ্বিতীয় রেকর্ড নিজের সুরে দুটি আধুনিক গান ‘মনে রেখো বলব না আর’ এবং ‘নদীর মত চল না যাই’। ১৯৫৫ সালে আরও দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করেছিলেন প্রবীর মজুমদারের সুরে। একটি হল প্রবোধ ঘোষের কথায় ‘এত রঙ কে দিলো আকাশে’ এবং পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে একটি অপূর্ব রোম্যান্টিক গান ‘যদি নিজেরে হারাই আমি তোমার চোখে’। তাঁর এরকম অন্য আরও পরিচয়ও রয়েছে। তবে আমরা মূলত তাঁকে চিনি তাঁর কণ্ঠে প্রবাদ হয়ে ওঠা ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে’, ‘হৃদয়বসন্তবনে যে মাধুরী বিকাশিল’, ‘অলকে কুসুম না দিও’, ‘ভালোবেসে যদি সুখ নাহি’, ‘বলি ও আমার গোলাপবালা’, ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে’, ‘আমার মন কেমন করে’, ‘নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ’, ‘আমার পরান যাহা চায়’, ‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া’, ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’, ‘বিধি ডাগর আঁখি যদি’, ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার’, ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো’, ‘এই লভিনু সঙ্গ তব’, ‘কাছে ছিলে, দূরে গেলে’, ‘গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে’, ‘ন্যায় অন্যায় জানি নে’, ‘পাত্রখানা যায় যদি যাক’, ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী’, ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি’, ‘আমার মাঝে তোমারই মায়া’ ইত্যাদি অসংখ্য রবীন্দ্রসঙ্গীতেই।

আরও পড়ুন
ক্যানসারে আক্রান্ত রজনীকান্ত সেন, চিকিৎসার খরচ জোগাতে বিক্রি করলেন গ্রন্থস্বত্ব

সঙ্গীতজগতে প্রবেশের পূর্বে কলেজ জীবনেই চিন্ময়ের শখ হয়েছিল হিরো হবার। কিন্তু স্বল্প অভিনয় জীবনের শুরুতেই ঘটল কেলেঙ্কারি ব্যাপার! সেই ঘটনা চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের বাল্যবন্ধু কৃষ্ণলাল মুখোপাধ্যায়ের লেখনীতে :

"এক সকালবেলা হঠাৎ রাসবিহারী মোড়ের বুক-স্টলে 'রূপমঞ্চের' মলাটে দেখি আমাদের সুদর্শন হিরো চিন্ময় আর চিত্রাভিনেত্রী প্রীতিধারার একখানি নিবিড় আলিঙ্গনবদ্ধ ছবি। চমকে উঠি। 'ক্ষুধিত পাষাণ'। ছবির পরিচালক ছিলেন যিনি তিনি বেলাইনের একজন মামুলি মস্তান বললেই চলে। রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় ওই নামে আইনবিরুদ্ধ ছবি ছিল বলেই বোধহয় ছবিটা রিলিজ অথবা শেষও হয়নি; কিন্তু চিন্ময়ের বাড়ি যেতেই ঘন ঘন সিগারেট টানতে টানতে মেসোমশাই দেখি পায়চারি করছেন দালানে ; দেখেই বলে উঠলেন, 'কেষ্ট, বাবুর কীর্তিকলাপ ওই সিনেমা পত্রিকার মলাটে একটা নোংরা ছবি, দেখেছ কি? আমতা আমতা করে সরে পড়ি, চিন্ময় গোঁজ হয়ে ঘরে বসে। বললে, বাবা খামোখা চেঁচামেচি করছে। কী করে বুঝব বল? ডিরেক্টর বলা কওয়া নেই, আমায় নায়িকার প্রাইভেট সাজঘরে ঠেলে দিলেন আর মেয়েটা এমনভাবে - কখন ক্যামেরা ক্লিক করেছে কে জানে, ছাপা হয়েছে জানিও না।" তবে অভিনয়ের শখ পূরণ হয়েছিল। ১৯৫২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বিশ্বামিত্র’ ছায়াছবিতে মুখ্য চরিত্রে ছিলেন চিন্ময়। এরপরের বছরই সুশীল মজুমদারের ‘মুস্কিল আসান’ ছবিতে জামাইয়ের ভূমিকায় দেখা যায় তাঁকে। অভিনয়ের খাতিরে নিজের সুন্দর বাবরি চুল ছেঁটে ফেলতে হয়েছিল। তবে দিব্যকান্তি চেহারা এবং অপূর্ব কণ্ঠস্বর থাকা সত্ত্বেও ছবি দুটি চলেনি। ভাগ্যিস! নইলে রবীন্দ্রসঙ্গীতে এমন অপূর্ব স্বতন্ত্র গায়নশৈলী কি পেতাম আমরা?

ব্যক্তি চিন্ময়ের ভদ্র, বিনয়ী, উদারচেতা শিল্পীসত্তার পাশাপাশি আড্ডাপ্রিয়তা, বন্ধুবাৎসল্য, প্রাণোচ্ছলতার জন্য তাঁর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল সব শিল্পীরই। জর্জ বিশ্বাসের সঙ্গে খুব মজা করতেন চিন্ময়। রবীন্দ্রসদনের এক অনুষ্ঠানে দুজনের দেখা হয়েছে। তাঁকে দেখেই জর্জ বিশ্বাস বললেন, "কিছুদিন আগেই তোমার স্টাইলে 'ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু' গানটা রেকর্ড করলাম।" চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ভীষণ অবাক। বললেন, "জর্জদা, আপনি এই কথাটা আমায় লিখে দিন, নয়ত কেউ বিশ্বাস করবে না।" ডাইরি থেকে একটি পাতা ছিঁড়ে তাতে দেবব্রত বিশ্বাস নিজে লিখে দিয়েছিলেন সেই কথা, চিন্ময়বাবুর খুড়তুতো ভাই বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সেটি এখনও সংরক্ষিত আছে। হয়ত কিছুটা মজার ছলে হলেও এ যেন রবীন্দ্রসঙ্গীতজগতের এক কিংবদন্তির থেকে পাওয়া সার্টিফিকেট, ভালবাসার প্রতীক! এই জর্জদাই "ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত"-এ লিখে দিয়েছিলেন- "চিন্ময় চ্যাটার্জি বইটি কিনে যে উদারতার পরিচয় দিলেন সেজন্য তাকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই।”

আরও পড়ুন
হেমন্ত যদি চিনা খবরের কাগজও সুর করে পড়ে, লোকে শুনবে - বলেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস

উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর ছিল দাদা-ভাইয়ের মতন সম্পর্ক। একটি ঘটনার কথা বলি। রবীন্দ্রসদনে এক অনুষ্ঠানে হেমন্তবাবুর পাশে বসে চিন্ময় বারবার দেখছেন তাঁর চটির দিকে। হেমন্ত খেয়াল করলেন ব্যাপারটা। জিজ্ঞেস করতে চিন্ময় বললেন, ‘হেমন্তদা, আপনার চটিজোড়া খুব সুন্দর। কোত্থেকে কিনেছেন?’ সস্নেহে হেমন্ত বললেন, ‘এটা তো কলকাতায় পাওয়া যায় না, বম্বে থেকে কেনা। তোমার লাগবে? পায়ের সাইজ বল।’ একটু লজ্জিত চিন্ময় বলেছিলেন, না, আমি এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম কলকাতায় যদি পাওয়া যায়’। পরেরবার বম্বে থেকে অনুজপ্রতিম চিন্ময়ের জন্য দু’জোড়া সাদা রঙের চটি কিনে এনেছিলেন হেমন্ত।

নিজের সঙ্গীত পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘শেষরক্ষা’ (১৯৭৭) এবং ‘নৌকাডুবি’ (১৯৭৯) - এই দুই ছবিতে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানদুটি ছিল যথাক্রমে ‘যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে’ (সহশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও ধীরেন বসু) এবং ‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো’। রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজেন্দ্রাণী সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ দিনের। খুব স্নেহ করতেন ভ্রাতৃসম চিন্ময়কে। ব্যথিত, শোকাহত হয়ে পড়েছিলেন বয়ঃকনিষ্ঠ চিন্ময়ের প্রয়াণে। মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গান যারা শুনতে ভালোবাসেন, অতি অল্পদিনের মধ্যেই চিন্ময় তাঁদের অন্তরে বিশিষ্ট একটি স্থান অধিকার করেছিল। ...চিন্ময়ের গানের মধ্যে স্বকীয়তা ছিল, নিজস্বতা ছিল।’ রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানে চিন্ময় যে অদ্বিতীয় ছিলেন, তার প্রমাণ দিয়েছেন সমসাময়িক আরেকজন কিংবদন্তি রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’-তে, ‘রবীন্দ্রনাথের গানের আর এক প্রেমের ঠাকুর ছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে গেলে উদ্যোক্তারা বলতেন, না না, আপনারা পূজা পর্যায়, নাটকের গান, এমন কি স্বদেশীও গাইতে পারেন। কিন্তু, আমাদের চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় আছেন, উনি প্রেমের গান গাইবেন।’ আমরা ওর সঙ্গে ঠাট্টাও করতাম এই নিয়ে। ও কিন্তু বেশ উপভোগ করত আর মিটিমিটি হাসত।’

দাবা খেলার খুব শখ ছিল চিন্ময়ের। বোর্ড নিয়েই ঘুরতেন। অনুষ্ঠানের আগে নিবিষ্ট মনে দাবা খেলতে দেখা যেত তাঁকে। আর ছিল ফুটবলের নেশা। মোহনবাগানের ফুটবল ম্যাচে দর্শকাসনে তাঁর উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। ওয়ার্ল্ড কাপে তাঁর প্রিয় টিম ছিল ব্রাজিল। এছাড়া ছিলেন দুজন ব্যক্তির খুব ভক্ত। অভিনেতা হিসেবে চার্লি চ্যাপলিনের। চ্যাপলিনের যেকটা ভিডিও টেপ সেসময়ে পাওয়া যেত সবকটিই ছিল তাঁর সংগ্রহে। তাঁর গানের ঘরের ভেতরে এবং বাইরে ছিল অভিনেতা চ্যাপলিনের দুটি বাঁধানো ছবি। এছাড়া ছিলেন একজন বাঙালি সাহিত্যিকের ফ্যান। পরশুরাম। তাঁর লেখা তিনখণ্ড গ্রন্থাবলির গল্পগুলি প্রায় সবই ছিল চিন্ময় বাবুর মুখস্থ।

আরও পড়ুন
'ঘুমের দরজা ঠেলে' এল পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পেলেন চিন্ময় গুহ

বইও লিখেছেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। তাঁর লেখা বই ‘বাংলা গানের গতিপথ’ ডি এম লাইব্রেরী থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। সঙ্গীতশিল্পী ছাড়াও তিনি ছিলেন বেঙ্গল মিউজিক কলেজের অধ্যক্ষ, রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির ভাইস-চেয়ারম্যান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আণ্ডার গ্র্যাজুয়েট কাউন্সিলের সদস্য, রবীন্দ্রসদনের আদি পরিষদের সদস্য, গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র উন্নয়ন পর্ষদের সদস্য এবং বাণীচক্রের শিক্ষক।

১৯৮৭ সাল। রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে, ইংরেজি মতে ২৭ জুলাই। ডঃ সমর চৌধুরীর কথায় ক্যালকাটা হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে। লিভারে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা। ৬৩৩ নং বেডে ডঃ এম সি ঘোষের আন্ডারে ভর্তি করা হল তাঁকে। বেডে নিয়ে যাওয়ার পর বড়দা জ্যোতির্ময় চট্টোপাধ্যায় ও খুড়তুতো ভাই বীরেন চট্টোপাধ্যায় টাকা জমা দিয়ে ওপরে উঠে আসার পর খবর পেলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন, কথা বলছেন না। ডাক্তার এলেন, সাক্সানের মেশিন এল, ইঞ্জেকশন দিয়ে আর্টিফিশিয়ালি হার্ট ম্যাসাজ করা শুরু হল। কিন্তু ফল হল না। বাঙালির গর্ব চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন। রাত তখন দুটো বেজে পঞ্চাশ মিনিট।

শিল্পীর প্রয়াণের পর গঠিত ‘চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি সংস্থা’-র সভাপতি এবং উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের অবদান স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি একটি বিশেষ গায়ন শৈলীতে রবীন্দ্রনাথের গানকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে শৈলীকে পরিপূর্ণ ভাবে গ্রহণ করেছিল তাঁর শ্রোতারা। আজও তিনি নবীন, সতেজ। তাঁর কণ্ঠের মাধুর্য তাঁকে মৃত্যুর অতীত এক জন্মের উপলব্ধিতে উজ্জ্বল করে রেখেছে। তাই বারবার তাঁর সুরের সুধায় আমরা ডুবতে পারি।’ 

অনিন্দ্যসুন্দর, মধুমাখা পেলব গভীর কণ্ঠাধিকারী শিল্পী চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় বিগতসময়ে, আজ এবং ভবিষ্যতেও রবীন্দ্রসঙ্গীতজগতের প্রেমের গানের অন্যতম এক পুরোধাপুরুষ হিসেবে থেকে যাবেন বাঙালির রক্তে, মজ্জায়, হৃদয়ের মণিকোঠায়। মৃত্যুর সাধ্য নেই তাঁকে বিস্মৃত করার। বাঙালি যতদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বুকে আগলে থাকবে, ততদিন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় প্রাসঙ্গিক থাকবেন আমাদের জীবনে। তাঁকে হারিয়ে ফেলার বেদনা ঢেকে দেবেন তিনিই তাঁর নিজের গানে। তাঁর গানের টানেই তাঁকে বারবার এইভাবেই স্মরণ করব আমরা, মনে রাখব তাঁর অবদান। অশ্রুসিক্ত চোখে ভাবীকাল প্রেমের ময়ূরসিংহাসনে তাঁর স্থানটি পাকা করে রাখতে বাধ্য।  

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ 

১) চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি সন্ধ্যায় বিতরিত পুস্তিকাসমূহ

২) সুরের আগুন - সন্ধ্যা সেন, দে'জ পাবলিশিং, ১৯৭৯

তথ্য সহযোগিতাঃ বীরেন চট্টোপাধ্যায় ও পার্থ চক্রবর্তী

Powered by Froala Editor

More From Author See More