ক্যানসারে আক্রান্ত রজনীকান্ত সেন, চিকিৎসার খরচ জোগাতে বিক্রি করলেন গ্রন্থস্বত্ব

সাল ১৯০৫। ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ভারতের সংগ্রাম তখন একটু একটু করে ফুটে উঠছে। দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবাদ, বিপ্লবী, বন্দে মাতরম শব্দগুলোর সঙ্গেও পরিচিত হচ্ছে বাঙালি। এমন সময় বড়লাট লর্ড কার্জন ঠিক করলেন, বাংলার ওপর দিয়ে ছুরি চালানো হবে। ভাগ করা হবে এই প্রদেশকে। তাতে নাকি শাসনকার্যের সুবিধা হবে। এর আড়ালের কারণ ধরে ফেলতে অসুবিধা হয়নি কারোর। আন্দোলনের তেজ এক ধাক্কায় বেড়ে গেল কয়েকগুণ। দলে দলে রাস্তায় নেমে পড়ল মানুষ। গোটা বাংলায় জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন। ব্রিটিশ পণ্য পুড়িয়ে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের ডাক দেওয়া হল। খাদির বস্ত্র যাতে সবাই ব্যবহার করে, সেই দাবি তোলা হল। স্বদেশি গানের রমরমা তখন। এমন পরিস্থিতিতে এক মধ্যবয়সী কবি এবং উকিল একটি গান বাঁধলেন। গান বাঁধার ব্যাপারে তাঁর নাকি বিশেষ হাতযশ আছে। অদ্ভুতভাবে তাঁর এই গানটি আলোড়ন তুলল সমাজে। রাস্তায় রাস্তায় যেখানেই যাওয়া যায় তাঁর লেখা গানটি গাইতে লাগলেন সবাই। এমনকি আজও এই গানটি অমর হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি রজনীকান্ত সেনও জায়গা করে নিলেন স্বদেশি আন্দোলনে, গানের মধ্য দিয়ে। গানটি ছিল- ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই/ দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই…’

গান রচনার ব্যাপারে রজনীকান্তের সত্যিই কোনো জুড়ি ছিল না। আর সেরকম ছিল দ্রুততা। লিখেই সঙ্গে সঙ্গে তুলে নেওয়া চাই। এই গান, সাহিত্য, কবিতা করেই আর আইনজীবী হওয়া হল না - এমন আক্ষেপ তিনি নিজেই করেছেন একসময়। বাবা ছিলেন আইনজীবী। অবশ্য তাঁর পাশাপাশি একটু আধটু সাহিত্যচর্চাও করতেন। সংসারে স্বচ্ছলতাও ছিল; কিন্তু অসুস্থতার জন্য একসময় বাধ্য হন অবসর নিতে। ফলে নেমে আসে দারিদ্র্য। কাকাও আইনজীবী হিসেবে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। কাজেই পরিবারের মান বজায় রাখতে রজনীকেও ঢুকতে হয় সেখানে। কিন্তু মাথায় সারাক্ষণ কবিতা আর গান ঘুরলে মক্কেল থাকবে কখন! কাজেই ব্যবসা গেল পণ্ড হয়ে। ভাগ্যিস! নইলে ‘কান্তকবি’ হওয়া আর হত না… 

মাত্র ১৫ বছর বয়সে গান রচনা। তারপর থেকে সেটা নেশায় ঢুকে যায়। তাঁর গান লেখার দ্রুততার সম্পর্কে বহু প্রবাদ প্রচলিত। একবার রাজশাহী গ্রন্থাগারে এক সাহিত্যসভায় যাওয়া হবে। বন্ধু অক্ষয়কুমার মৈত্র বললেন, খালি হাতে কেন, কিছু গান নিয়ে যাও। রজনীকান্ত সঙ্গে সঙ্গে গান লিখতে বসে গেলেন। এবং আশ্চর্য, খানিকক্ষণ পর লিখেও ফেললেন সেই গান। তারপর সুরও দেওয়া হয়ে গেল। গানটি ছিল- ‘তব চরণ-নিম্নে/ উৎসবময়ী শ্যাম-ধরণী সরসা।’

দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তি, তেমনই দুর্দান্ত রসবোধ। কিন্তু সবই থমকে দিল একটা শব্দ। ক্যানসার। যে গলা দিয়ে এক সময় এত গান বেরিয়েছে, সেই গলাতেই বাসা বাঁধল মারণরোগ। মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার জানিয়েছিলেন গলায় ‘ওভারস্ট্রেনিং’-এর জন্যই শ্বাসনালীতে এমন রোগ। কিন্তু সে সময় চিকিৎসার খরচ জোগানোই দুষ্কর হয়ে উঠেছিল তাঁর। বাধ্য হয়েই নিজের প্রিয় দুটি বই ‘বাণী’ এবং ‘কল্যাণী’-র গ্রন্থস্বত্ব বিক্রি করলেন তিনি। মাত্র চারশো টাকায়। বিক্রি করেছিলেন আরও কিছু বই। স্ত্রী-র কান্না দেখে বলেছিলেন, “আমাকে যদি দয়াল আর কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখে তবে শত সহস্র বাণী, কল্যাণী লিখে তোমার পায়ে অঞ্জলি দেব। তুমি আর কেঁদো না।”

একটা সময় এত মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছেন। নিজের দুই ভাই ও বোনের মৃত্যুকে দেখেছেন ছোটো বয়সেই। নিজের এক ছেলে ও এক মেয়েকেও হারান। তাঁর নিজের এমন একটা রোগ— কোথায় প্রেরণা পাবেন? এর উত্তর ছিল রজনীকান্তের কাছে। বারবার ছুটে গিয়েছেন তাঁর কাছে। ওই মানুষটিও তো কত কষ্ট পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মেডিক্যাল কলেজে যখন ভর্তি হলেন রজনীকান্ত সেন, তখন তাঁর ভগ্নপ্রায় চেহারা। যেন চেনা যাচ্ছে না মানুষটিকে। কথা বলতে পারছেন না। কে বলবে ওই গলা দিয়ে এই তো সেদিনও গান বেরিয়েছে কত! রজনীকান্তকে দেখতে মেডিক্যাল কলেজে পা রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। 

রবীন্দ্রনাথ রজনীকান্তকে বরাবর স্নেহ করে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথকে দেখেই শয্যা থেকে উঠে এলেন রজনীকান্ত। তখন কথা বলতে পারেন না কান্তকবি। ট্রাকিয়াটমির অপারেশনে গলায় ছোট্ট ছিদ্রের মাধ্যমেই শ্বাস-প্রশ্বাস। রবি ঠাকুরকে দেখে যা বলার ছিল, খাতায় লিখে দিলেন রজনীকান্ত। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন। প্রত্যক্ষ করলেন জীবনের এক অবিমিশ্র সত্যের কথা। যে সত্য আমাদের ভেতর দিয়ে জগতের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। তার সামনে আমরা নেহাতই ক্ষুদ্র। রবীন্দ্রনাথকে সে রাতেই গান লিখে পাঠালেন তিনি। 'এই মুক্ত প্রাণের দৃপ্ত বাসনা'। যে গানটির নাম ছিল 'যজ্ঞভাঙা'। বোলপুরে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথও লিখলেন নিজের অনুভূতি। ‘‘শরীর হার মানিয়াছে কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই। কণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে কিন্তু সঙ্গীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই। পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই।...আত্মার এই মুক্ত স্বরূপ দেখিবার সুযোগ কি সহজে ঘটে।’’ ততদিনে, মাত্র ৪৫ বছর বয়সে কান্তকবিও থেমেছেন…

আরও পড়ুন
দীনেন রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রভাত মুকুজ্জের হাড়কাঁপানো অশরীরী

Powered by Froala Editor