ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করবেন রবীন্দ্রনাথ, সুপারিশের জন্য দ্বারস্থ গিরীন্দ্রশেখরের

বিশ্ব পরিক্রমার সূত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ একদিন ঠিক করলেন জার্মানি যাবেন। অন্য অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ভিয়েনা শহরে গিয়ে মনোবিকলন তত্ত্বের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু ফ্রয়েড যদি দেখা না করেন? হতে পারেন রবীন্দ্রনাথ নোবেলজয়ী সাহিত্যিক, কিন্তু ফ্রয়েড কি তাঁকে পাত্তা দেবেন? কবিগুরু তাই কলকাতা থেকেই একজনের চিঠি সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তাঁর সুপারিশ থাকলে ফ্রয়েড নিয়শ্চই দেখা করবেন! এমন একটা ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির কাছে অবাক লাগার মতো। তবে হ্যাঁ, ফ্রয়েডের বন্ধু হলেও আপামর বাঙালি যে তাঁকে খুব একটা মনে রেখেছে, তা নয়। বরং নামটাও অপরিচিত লাগতে পারে। এই মানুষটির নাম গিরীন্দ্রশেখর বসু।

নামে চিনতে না পারলে আরেকটি সূত্র ধরিয়ে দেওয়া যাক। গিরীন্দ্রশেখরের দাদার নাম বললেই নিশ্চই অনেকে চিনতে পারবেন। রাজশেখর বসু, ওরফে পরশুরাম। দাদার মতোই গিরীন্দ্রশেখর ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের ছাত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পড়াশুনো করে ভর্তি হন ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে। সেখান থেকেই স্নাতক। হঠাৎ বিয়ের সম্মন্ধ এসে পড়ায় ডাক্তারি পড়া খানিকটা বাধা পেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাক্তার হলেন গিরীন্দ্রশেখর। তবে শরীরের নয়। তিনিই এদেশের প্রথম মনের ডাক্তার। ভারতে সাইকো-অ্যানালিটিক বিভাগের জনক তিনি। তাঁর হাত ধরেই ১৯২২ সালে তৈরি হয়েছিল 'ইন্ডিয়ান সাইকো-অ্যানালিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন'। আজ প্রায় শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই সংগঠন।

মনোবিজ্ঞান তো বটেই, বোধহয় বিজ্ঞানের সমস্ত ধারাতেই একধরনের লড়াই ঘটে এসেছে বিভিন্ন সময়। তা হল একদিকে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা, এবং অন্যদিকে একটি উপপাদ্য কল্পনা করে নিয়ে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য নানা উদাহরণ স্থাপন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিষ শতকের শুরু পর্যন্ত এই দ্বন্দ্ব সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। এখানে গিরীন্দ্রশেখর কিন্তু ফ্রয়েডের মতোই বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে এগোতে শুরু করলেন। অন্যদিকে বিভিন্ন ধর্মীয় ন্যায়, নীতি ও আদর্শবোধ মিশিয়ে যে ককটেল সাইকোলজি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তাকে ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করেছিলেন গিরীন্দ্রশেখর।

মানুষের মনস্তত্ত্বের বাস্তব পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো মানেই এমন কিছু সত্যের অনুসন্ধান, প্রচলিত নৈতিকতার ধারণাকে যা এক লহমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। ফলে ফ্রয়েডের মতোই সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল গিরীন্দ্রশেখরকেও। ১৯২১ সালে গবেষণাপত্রে তিনি যে মানসিক অবদমনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটা মানতে চাননি ফ্রয়েড নিজেও। কিন্তু গিরীন্দ্রশেখর নিজের তত্ত্বের ব্যাপারে কখনো সন্দিহান হয়ে ওঠেনি। জোর গলায় বারবার বলে গিয়েছেন, পরিণত বয়সের যে-কোনো অস্বাভাবিক ক্রিয়ার পিছনে থাকে শৈশবের কোনো ব্যাহত অধ্যায়। তবে এখানে লক্ষ্য করার বিষয়, দুজনের সিদ্ধান্ত আলাদা হলেও এগিয়েছিলেন একই পথেই। ১৯১৫ সালে ছাত্রাবস্থা থেকেই ফ্রয়েডের লেখার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন গিরীন্দ্রশেখর। বরং প্যাভলভের পরীক্ষামূলক মনস্তত্ত্বের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও গিরীন্দ্রশেখর সেই পথে যাননি।

গিরীন্দ্রশেখরের গবেষণার আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক অবশ্য আলোচনার দাবি রাখে। তা হল সময়ের প্রভাব। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সমসময়ে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারণাও। আর গিরীন্দ্রশেখরকেও তাই বারবার ফিরে যেতে দেখবো পুরাণের কাহিনীতে। সেখানেই মনস্তত্ত্বের প্রাথমিক রস আছে বলে মনে করতেন তিনি। এমনকি গীতার মনবিকলন তত্ত্বের সাহায্যে তিনি মানুষের নানাবিধ চরিত্রের আলোচনাও করেছেন। বলা বাহুল্য, তাঁর এই পর্বের আলোচনায় অনেকেই বিজ্ঞান থেকে বিচ্যুতির লক্ষণ খুঁজে পান। কিন্তু একটু ভালোভাবে দেখলে অবশ্য বিষয়টা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। মনোবিকলনের ব্যাখ্যায় এখানে পদ্ধতিতান্ত্রিক ভুল থেকে গিয়েছে। কিন্তু যেকোনো প্রাচীন কাহিনীর মধ্যেও গণ-মনস্তত্ত্বের যে প্রকাশ পাওয়া যায়, তাই হয়তো খুঁজতে চেয়েছিলেন গিরীন্দ্রশেখর। কিন্তু সেটা তো মনোবিকলনের পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা যায় না।

তবে সমস্ত সাফল্য-ব্যর্থতা এবং ভ্রান্তির সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, গিরীন্দ্রশেখর না থাকলে মনোবিজ্ঞানের গবেষণার একটা বড় অংশই অধরা থেকে যেত হয়তো। আর সেই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন খোদ ফ্রয়েডের কাছ থেকে। অনেক বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও ফ্রয়েড চিনেছিলেন সমকালের অন্যতম শক্তিশালী একজন মনস্তাত্ত্বিককে। দুজনের দ্বন্দ্বপূর্ণ পত্রালাপ আজও গবেষকদের কাছে আলোচনার বিষয়। লন্ডনের ফ্রয়েড আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে গিরীন্দ্রশেখরের নামাঙ্কিত আস্ত একটি গ্যালারি। শুধু আট বছর আগে তাঁর ১২৫তম জন্মদিন পেরিয়ে গেল নীরবতায় এবং অবহেলায়। বাঙালির স্মৃতিতে হয়তো তিনি বাড়তি, অপাংক্তেয়।

আরও পড়ুন
করোনায় আক্রান্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা

তথ্যসূত্রঃ গিরীন্দ্রশেখর বসু : বিজ্ঞানে-পুরাণে দোলায়িত, আশীষ লাহিড়ী

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More