কণিকা-কে রঙের চৌবাচ্চায় ফেলে দিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, ‘শাস্তি’র ব্যবস্থা রবীন্দ্রনাথের

সকালে উঠে খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। আজকেও যেমন, চল্লিশের দশকেও তেমন। বরং আরও খানিক বেশি। এরকমই একদিন কাগজের একটি বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ আটকে গেল অনেকের। বিখ্যাত পরিচালক কালীপ্রসাদ ঘোষ নতুন সিনেমা বের করবেন; তার জন্য নতুন ছেলে চাই। স্বাভাবিকভাবেই, প্রচুর দরখাস্ত জমা পড়তে লাগল। সেই দলে ভিড়ল আরও একজন ছেলে। সে ডাক্তারি পড়ছে; কিন্তু সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। সেই সূত্রেই অভিনয়ের জন্য দরখাস্ত পাঠানো। এত এত ছেলে, সবার ভাগ্যে তো আর শিকে ছিঁড়বে না! কিন্তু তাও চেষ্টা করতে ছাড়েনি ওই ছেলেটি।

তার ফল? ১৯৪৮ সালে সামনে এল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে কালীপ্রসাদ ঘোষের সিনেমা ‘ধাত্রীদেবতা’। আর তাতেই সুযোগ পেল ওই ছেলেটি, রামরতন মাস্টারের চরিত্রে। সেখান থেকেই শুরু হল যাত্রা। তারপর সময় এগিয়েছে, নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছে ছেলেটিও। ডাক্তারি ছেড়ে তখন স্বনামধন্য একজন পরিচালক। সেদিনের আনকোরা ছেলেটিকে নিজের নামেই চেনে সবাই— অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। বাংলা সিনেমার জগতে এই নামটির স্থান ঠিক কোথায়, নতুন করে বলার দরকার নেই নিশ্চয়ই। শুধু একটাই কথা; সেদিনের কালীপ্রসাদ ঘোষের সিনেমায় পার্ট পাওয়ার জন্য যারা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও ছিলেন আরও দুজন। তাঁরা অবশ্য তখন সেই সিনেমায় সুযোগ পাননি। ভদ্রলোক দুজনের নাম, জহর রায় এবং শম্ভু মিত্র… 

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ আসলে তাঁর পরিচালনা, প্রবল আহ্বান সত্ত্বেও মুম্বইতে না যাওয়া; এবং উত্তম কুমারের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত কিছু ছবি— এসবই আলোচনায় আসবে। এখান থেকে একটু বেরনো যাক। যে পরিবারে বড়ো হয়েছিলেন তিনি, তাঁর একটা প্রভাব তো সবসময়ই তাঁর ওপর ছিল। বাবা ছিলেন তখনকার নামী ডাক্তার সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়। বড়ো দাদা ছিলেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যে যিনি ‘বনফুল’ নামে অমর হয়ে আছেন। অরবিন্দবাবুও ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে; কিন্তু মন বসেনি। ততদিনে সিনেমার ভূত ঘাড়ে চেপেছে। কলকাতায় এসে যোগাযোগ পরিচালক বিমল রায়ের সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গেই বেশ কিছু ছবিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের কাজ করেন। 

অরবিন্দবাবুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মুখে। চারিদিকে ভয়ের আবহাওয়া। এমন পরিস্থিতিতে তিনি ভর্তি হলেন শান্তিনিকেতনে। সেখানে তখন চাঁদের হাট; স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো আছেনই, তাঁর সঙ্গে আছেন রামকিঙ্কর বেইজ, বলরাজ সাহানি, ক্ষিতিমোহন সেনের মতো দিকপালরা। এই পরিমণ্ডলটাই একটা বিরাট ছাপ ফেলে যায় অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের জীবনে। কিছু স্মরণীয় ঘটনাও ঘটিয়েছিলেন সেখানে। অরবিন্দ সম্পর্কে বনফুলের ছোটো ভাই, আর বনফুল রবি ঠাকুরেরও অত্যন্ত স্নেহধন্য। সেইজন্য একদিন আলাদা করে ডেকে পাঠালেন তাঁকে। কোনো এক সূত্রে অরবিন্দ খবর পান, বয়সের কারণে রবীন্দ্রনাথ কানে একটু কম শুনছেন। কাজেই রবীন্দ্রনাথ যখন জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি বলাইয়ের ভাই কানাই?”; কিশোর অরবিন্দ একপ্রকার চেঁচিয়েই উত্তর দিয়েছিল, “আজ্ঞে না, আমি অরবিন্দ।” সেই কাণ্ড দেখে রবি ঠাকুর অবাক হয়ে বলেছিলেন, “তুমি তো কানাই নও, তুমি যে সানাই!”

আরও পড়ুন
তর্কের জবাব দিতেন না ‘বৌঠাকরুন’, কাদম্বরীর কাছে রবীন্দ্রনাথের হার ছিল অবশ্যম্ভাবী

আরও দুটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করার মতো। অরবিন্দবাবু তো বটেই, প্রায় সবাই শান্তিনিকেতনের ছাত্রাবাসে থাকতেন। সবসময় তো শান্ত থাকা যায় না, আর তখন সবার অল্প বয়স; সবাই ঘরের মধ্যেই দৌরাত্ম্য করতেন। একটা স্বাধীন পরিবেশ ছিল। এরমই একদিন অরবিন্দবাবু ও তাঁর বন্ধুরা ঘরে বালিশ ছোঁড়াছুড়ি খেলছেন। এমনই মগ্ন হয়ে গেছেন যে খেয়ালও করেননি ঘরে আরেকজন এসে উপস্থিত হয়েছেন। সেই সময়ই একটি বালিশ ওই আগন্তুকের পায়ে এসে পড়ল। সেটা তুলে নিয়ে আগন্তুক বললেন, “তোমাদের দেখে বেশ হিংসে হচ্ছে আমার। আমি এমন মজা করতে পারছি না।” আগন্তুকের নাম জওহরলাল নেহরু; তিনি পরিদর্শনে এসেছিলেন হোস্টেলে… 

আরও পড়ুন
‘কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং’ – স্বল্প স্কুলজীবনে এমনই আবৃত্তি শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করার মতো। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় যে সময় শান্তিনিকেতনে পড়তেন, তখন তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ। সবাই মিলেই নানা অনুষ্ঠান করতেন। অভিনয়, নাটক তো ছিলই। একবার একটি নাটকে নায়ক ও নায়িকার ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্র। এছাড়াও ছিল নিজেদেরই একটি পত্রিকা, নাম ছিল ‘একেবারে যাতা’! তাতে প্রকাশকের জায়গায় লেখা থাকত ‘তুমি’, আর সম্পাদকের জায়গায় ছিল ‘আমি’। তারই প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। যাই হোক, একবার দোলের সময় একটি রংভরা চৌবাচ্চার মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফেলে দিয়েছিলেন অরবিন্দবাবু। নিছক মজার জন্যই এমন করা। কিন্তু কণিকা গেলেন রেগে! সোজা চলে গেলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। বিকেলে বসল বিচারসভা। রথী ঠাকুরের সঙ্গে উপস্থিত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। সমস্ত ঘটনা শুনে রবীন্দ্রনাথ ‘ব্যবস্থা’ করলেন। দুজনকে ডেকে পরস্পরের হাত মিলিয়ে দিলেন। বললেন, আর যেন তোরা দুটিতে কোনো ঝগড়া না করিস। সেই সময় শান্তিনিকেতনের গঠন, শিক্ষা এবং পরিবেশ কীরকম ছিল এইরকম টুকরো টুকরো ঘটনাই তাঁর প্রমাণ। 

আরও পড়ুন
নিতান্ত ছেলেবেলাতেই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ-চর্চা

পরিচালক হিসেবে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে অমর হয়ে থাকবেন। ‘অগ্নিশ্বর’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মৌচাক’— একের পর এক হিট ছবি উপহার দিয়েছিলেন তিনি। তেমনই ছিল তাঁর চিত্রনাট্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই কাজটি করতেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় নিজে। এখানে একটি ছোট্ট গল্প উল্লেখ করা প্রয়োজন। ‘নিশিপদ্ম’ সিনেমাটির মূল গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। এর হিন্দি রিমেক ‘অমর প্রেম’ও তাই। কিন্তু এই সিনেমার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দুটো অদ্ভুত তথ্য। প্রথমত, উত্তমকুমার বা রাজেশ খান্নার যে চরিত্রটি আমরা পর্দায় দেখি, সেটি বিভূতিভূষণের সৃষ্ট চরিত্র নয়, তার নির্মাতা স্বয়ং অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র একটি গল্পের ওপর ভিত্তি করেই সিনেমাটি তৈরি হয়নি। বিভূতিভূষণের দুটি ছোটগল্প মিশিয়ে তারপর সেটাকে নিজের মতো রূপ দিয়েছিলেন অরবিন্দবাবু। ‘অমর প্রেম’-এর চিত্রনাট্যকার হিসেবে ফিল্মফেয়ারও পান অরবিন্দ। 

আরও পড়ুন
অনশন শুরু করলেন জেলবন্দি নজরুল, প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম রবীন্দ্রনাথের

তবে আসল পুরস্কার ছিল দর্শকরা। তাঁরা আজও অরবিন্দবাবুকে, তাঁর সৃষ্ট সিনেমাগুলিকে মনে রেখেছেন। বারবার ফিরে ফিরে দেখেন। সেটাই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার। সেই সঙ্গে ছিল লেখা। বাংলা সিনেমার ইতিহাস নিয়ে অজস্র লেখা লিখে গেছেন তিনি; যা আজ অমূল্য সম্পদ! শেষটা হোক উত্তমকুমারের সঙ্গে একটি স্মৃতি দিয়ে। ‘অগ্নিশ্বর’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে উত্তমকুমারের নাম ঘোষিত হয়। কিন্তু আর কোনো পুরস্কার দেওয়া হবে না। পরিচালক হিসেবেও অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় কোনো পুরস্কার পাবেন না। এই খবরটা জানতে পারার পর উত্তমকুমার সবিনয়ে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, “এই ছবিটা সফল হওয়ার পেছনে শুধু আমি নই, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ও আছেন। তাঁর অবদান কোনো অংশে কম নয়। তাঁকে যদি পুরস্কার না দেওয়া হয়, তাহলে আমিও নেব না।” জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এগুলো নিয়েই বেঁচে ছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। 

আরও পড়ুন
নীলরতন সরকারকে না জানিয়েই অপারেশন, অজ্ঞান রবীন্দ্রনাথকে দেখে গেলেন নীরবেই

বোদ্ধাদের জন্য নয়, ফিল্মে নিটোল গল্প শোনাতেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় – সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা :  ১৫ জুন, ২০১৯

আরও পড়ুন
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কণ্ঠে উচ্চারিত রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’, জন্মদিনে বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি

ধন্যি ঢুলুবাবু – ঋজু বসু, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ মে, ২০১৪

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে সংকলন; স্পনসর আইনস্টাইন, রোমাঁ রোলাঁ

গোপাল দাস।

Powered by Froala Editor

More From Author See More