অনশন শুরু করলেন জেলবন্দি নজরুল, প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম রবীন্দ্রনাথের

বাঙালির মে মাস এমন করে কাটেনি অনেকদিন। মে মাস জুড়ে রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ-পর্ব এবার অনেকটাই স্তিমিত। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আম্ফান-বিপর্যয়ও। বন্দিজীবনে হাঁপ ধরেছে, অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগে কাটছে দিন। এর কিছুটা যেন আড়ালেই রয়ে গেলেন মে মাসের আর এক জাতক – যাঁর জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৫ মে, যাঁর লেখা অবিস্মরণীয় ‘ভাঙ্গার গান’ আর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষের সূচনাও হবে এ-বছরই। আর ১৯২২ সালে তাঁর ঐতিহাসিক কারাবাসের এক বড় অংশ জুড়েও ছিল এই মে মাস।

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস। নজরুল কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পর রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত 'ভাঙার গান' - 'কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট' এবং 'বিদ্রোহী' কবিতা - 'বল বীর চির উন্নত মম শির'। বাংলা সঙ্গীত ও কবিতার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা বিপ্লবী গান আর কবিতা। 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নজরুলের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবিভক্ত বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নজরুলের কলম থেকে বেরিয়েছিল 'বিদ্রোহী' ছাড়া আরও একটি স্মরণীয় কবিতা - 'কামাল পাশা'।

‘মোসলেম ভারত’ এবং ‘বিজলী’ পত্রিকায় একযোগে প্রকাশিত হল তাঁর ঝোড়ো হাওয়ার মত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। “আপনারে ছাড়া কাহারে করি না কুর্নিস” - নজরুলের এই স্পর্ধিত বাণীতে জেগে উঠেছিল সারা বাংলা। চিন্তায় পড়ে গেল রাজশক্তি। রাতারাতি নজরুলের উপর সরকারপক্ষের নজরদারি শুরু হল। একে একে নজরুলের অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থ সরকারি ভাবে বাজেয়াপ্ত হল।

১৯২২ সালে বাংলা ফৌজদারি বিধির ৯৯এ ধারায় সরকার নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘যুগবাণী’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বছর দুয়েকের মধ্যেই ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ হয় ‘বিষের বাঁশি’। তবে নিষিদ্ধ করেও বইটির প্রচার আটকানো যায়নি। উপরের মলাট ছাড়াই এ-বই কলকাতার বিভিন্ন প্রেস থেকে ছাপা হতে থাকে। এর কিছুদিন পরই নিষিদ্ধ হয় ‘ভাঙার গান’। ১৯৩০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে নিষিদ্ধ হয় ‘প্রলয় শিখা’।

‘প্রলয় শিখা’ নিষিদ্ধকরণের আগেই, সরকার বিরোধী মানসিকতা প্রচারের অপরাধে কবি একবার ছয় মাসের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার তিনি দীর্ঘকালীন কারাবাসে বাধ্য হলেন তাঁরই সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ (১৯২২, ২৬ সেপ্টেম্বর)পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির জন্য। ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারা অনুসারে তাঁকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁকে প্রথম প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় আলিপুর জেলে। এখানে দীর্ঘদিন ছিলেন তিনি। এই কারাবাসের সময়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এরপর আলিপুর জেল থেকে কবিকে হুগলিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কেমন ছিল কবির বন্দিজীবন? কলকাতা থেকে তাঁকে হুগলির জেলে আনা হয়েছিল কোমরে দড়ি বেঁধে। জেলে ঢুকেই শুরু হয় তাঁর চিৎকার করে গান, “দে গরুর গা ধুইয়ে।’ এমন তরতাজা, হাসিখুশি কবি-গায়ককে কাছে পেয়ে জেলের অন্যান্য বন্দিরাও গানে, আবৃত্তিতে মেতে থাকতেন। হুগলি জেলের অত্যাচারী সুপার আর্সটন সাহেবকে ব্যঙ্গ করে রবীন্দ্রনাথের ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে’ গানটির বিখ্যাত প্যারডি রচনা করেন নজরুল –“তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে, তুমি ধন্য ধন্য হে”।

বন্দিদশাতেও এত আনন্দ, আবার রসিকতা! সহ্য হল না কর্তৃপক্ষের। এখানেই তাঁর উপর শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। হাতকড়ার পরিবর্তে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হত তাঁকে, ভাতের পরিবর্তে খেতে দেওয়া হত ভাতের মাড়। নজরুল জেলের এইসব অবিচার আর উৎপীড়নের প্রতিবাদে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অনশন শুরু করেন। এপ্রিল-মে মাস, প্রচণ্ড গরম – তার মধ্যে অনশনে কবির স্বাস্থ্যের আশঙ্কাজনক অবনতি হয়। বাংলার জনগণ সে খবর শুনে উদ্বেগে, ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সেন্ট্রাল জেলের ঠিকানায় নজরুলকে অনশন ভাঙার অনুরোধ জানিয়ে জরুরি তার পাঠান, “গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।” জেলের কর্তারা সে টেলিগ্রাম নজরুলের কাছে পৌঁছে দেননি পর্যন্ত। ‘অ্যাড্রেস নট ফাউন্ড’ লিখে সেই বার্তা ফেরত পাঠানো হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে।

শেষ পর্যন্ত মাতৃস্থানীয়া বিরজাসুন্দরী দেবীর অনুরোধে ৩৯ দিন পর ২২ মে নজরুল তাঁর অনশন ভঙ্গ করেন। এর কিছুদিন পরই তাঁকে হুগলির জেল থেকে স্থানান্তরিত করে বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়। এখানে কবির সহবন্দি হিসেবে কিছুদিন ছিলেন রসসাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, কারাবাসের কালেও কবির মনোবল ভেঙে পড়েনি, বরং তিনি বরাবর উৎসাহ আর সজীবতায় ভরপুর ছিলেন। প্রতিদিন রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হবার পর নজরুল সহবন্দিদের নিয়ে বসাতেন আবৃত্তি আর গানের আসর। “নিজের গানের চেয়েও বেশি গাইত সে রবীন্দ্রসংগীত”, লিখেছেন শিবরাম। কবি মাঝেমধ্যে আবার কয়েদখানার পাচকদের হটিয়ে দিয়ে নিজেই লাগতেন রান্নায়। এ-প্রসঙ্গে শিবরামের সরস মন্তব্য - “কয়েদখানার পাক-ই-স্তানের কায়েদে আজম নজরুল… কতো রকমের রান্নার কায়দাকানুন জানা তার, তা বলবার নয়।” শোনা যায়, তাঁর রান্না খেয়ে অনেক রাজবন্দির নাকি ওজন বেড়ে গিয়েছিল।

বন্দিদশাতেই কবি বেঁধেছিলেন শিকল ভাঙার গান - ‘শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল/এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।’ বন্দিজীবনের দুর্দশা আর যন্ত্রণাকে এমন সরস করে তুলতে পারেন যিনি, বিপদ, প্রলয় আর ঝঞ্ঝা যার কাছে তুচ্ছ -- তাঁর জন্মদিনটা এই লকডাউনের নিরানন্দ আবহে ঘরে বসেই একটু স্মরণ করে বাঁচার প্রেরণা কি পেতে পারি না আমরা?

Powered by Froala Editor