যদুভট্টের থেকে পালিয়ে বেড়াতেন রবীন্দ্রনাথ, স্বীকার করেছেন নিজের গানের সীমাবদ্ধতাও

সূর্যস্নান।। পর্ব ৭।। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলায়, বিশিষ্ট ধনী পরিবারে সংগীতবিদ্যার চর্চা ছিল বৈদগ্ধ্যের এক অন্যতম প্রমাণ। এখন যেমন ইংরাজি লিখতে গিয়ে বানান ভুল বা ব্যাকরণের গণ্ডগোল হলে লজ্জায় পড়তে হয়, তখন ঠিক তেমনি হত, যদি দেখা যেত - সম্মাননীয় পরিবারের কেউ গান শোনাবার সময় সমে মাথা নাড়ায় ভুল করে ফেলেছে, অথবা ওস্তাদকে রাগরাগিণী ফরমায়েশ করার সময় রীতি রক্ষা করতে পারেনি। তাতে যেন বংশমর্যাদায় দাগ পড়ত তখন। জনসমাজে সঙ্গীতের স্থান ছিল এতটাই উচ্চে। দূর প্রদেশ থেকে বিখ্যাত গুণীদের আমন্ত্রণ করে এনে স্বগৃহে জমকালো সঙ্গীতের আসর রচনা করা তখন বড়লোকদের আত্মসম্মান রক্ষার এক প্রধান অঙ্গ ছিল।

কেবল সঙ্গীত পরিবেশন নয়, সঙ্গীতশিক্ষাকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেবার ব্যাপারে সেকালের বাবুমশাইরা ছিলেন অকৃপণ। তখনকার সমাজ জানত, বিদ্যার যে-কোনো বিষয়ই অতি যত্নে শিক্ষণীয় ও রক্ষণীয়। ধনীরা বিদ্যার চর্চাকে বাঁচিয়ে রাখবার দায়িত্ব নিতেন গৌরবের সঙ্গে। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর এই অনায়াস সখ্যের কল্যাণেই সেকালের শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা সমাজে উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানের সৃষ্টি ও পুষ্টি-বিধান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সঙ্গীতবিদ্যা এই সকল বিদ্যার মধ্যে ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ একখানি রত্ন।

যে-সব ধনীদের ঘরে তখন বৃত্তিভোগী গায়কেরা বাস করতেন, তাঁদের কাছে সমভাবে শিক্ষালাভ করত ঘরের লোক ও বাইরের লোক। রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, "বস্তুত এই-সকল জায়গা ছিল উচ্চ সংগীত শিক্ষার ছোটো ছোটো কলেজ।" ঠাকুরবাড়িও এর ব্যতিক্রম নয়। সুদূর অযোধ্যা, গোয়ালিয়র, মোরাদাবাদ থেকে নামকরা ওস্তাদদের শুভাগমন ঘটত জোড়াসাঁকোয়। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ কিছুদিনের জন্য বিদ্যা বিতরণের কাজে সেখানে স্থায়ী হতেন।

অন্যান্য সঙ্গীতাচার্যদের সঙ্গে, বিখ্যাত বাঙালি সংগীতনায়ক যদুভট্টও থাকতেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। তখন নানারকম লোক আসত তাঁর কাছে শিক্ষা পেতে। তাদের মধ্যে কেউ শিখত মৃদঙ্গের বোল, কেউ বা রাগরাগিণীর আলাপ। এই কলরবমুখর লোকসমাগমে কোথাও কোনো নিষেধের আবরণ ছিল না তখন। সেই ছিল বিদ্যাকে রক্ষা করবার ও ছড়িয়ে দেবার যথার্থ ও সহজ উপায়। 

যদুভট্টের জন্ম বিষ্ণুপুরে, ১৮৪০ সালে। তাঁর প্রকৃত নাম যদুনাথ ভট্টাচার্য। মার্গসঙ্গীতে তাঁর প্রথম গুরু ছিলেন তাঁর পিতা মধুসূদন ভট্টাচার্য, যিনি কিনা সেকালের বিষ্ণুপুরী রাজবংশের প্রসাদধন্য গায়ক ও বীণাবাদক। পিতার কাছেই যদু শিখেছিলেন বীণা, মৃদঙ্গ, সুরবাহার, পাখোয়াজ, সেতার। তারপর ক্রমে রামশঙ্কর ভট্টাচার্য, গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায় সহ কাশীপুর, গোয়ালিয়র, জয়পুর প্রভৃতি নানা স্থানের বরেণ্য আচার্যদের পদপ্রান্তে বসে শিক্ষালাভ করলেন তিনি, আয়ত্ত করলেন ভারতীয় সঙ্গীতের বহুবিধ ঘরানা। তারপর, নানা বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে ও সামঞ্জস্যে বিষ্ণুপুর ঘরানাকে সমৃদ্ধ করে তোলার ব্রতে আত্মনিয়োগ করলেন তিনি। মাত্র তেতাল্লিশ বছরের জীবৎকালে বাংলার সঙ্গীতজগতে আলোড়ন ফেলে গেলেন যদুনাথ। রাজারাজড়া থেকে আরম্ভ করে আপামর বঙ্গবাসী তাঁর প্রতিভায় বিস্ময়মুগ্ধ ছিলেন। পঞ্চকোটের রাজার কাছে 'বঙ্গনাথ', আর ত্রিপুরারাজের কাছে 'তানরাজ' উপাধিতে তিনি ভূষিত হন। 

আরও পড়ুন
ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করবেন রবীন্দ্রনাথ, সুপারিশের জন্য দ্বারস্থ গিরীন্দ্রশেখরের

ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীতশিক্ষক হিসাবে তাঁর অবদান কীরকম সুদূরপ্রসারী, একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে তা বোঝা যাবে। যদুনাথ কাফি সুরে একটি বর্ষার গান বেঁধেছিলেন- ‘রুম ঝুম বরষে আজু বাদরওয়া।’ এই একটি গান ভেঙে তিনটি ব্রহ্মসঙ্গীত লিখেছিলেন ঠাকুরবাড়ির তিন প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘দীন হীন ভকতে, নাথ, কর দয়া’; জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘তুমি হে ভরসা মম অকূল পাথারে’; রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ, পথে পথে’। ভাবা যায়! 

যদুভট্ট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "তিনি ওস্তাদজাতের চেয়ে ছিলেন অনেক বড়ো। তাঁকে গাইয়ে বলে বর্ণনা করলে খাটো করা হয়। তাঁর ছিল প্রতিভা, অর্থাৎ সংগীত তাঁর চিত্তের মধ্যে রূপ ধারণ করত।" যদুভট্টের রচিত গানের মধ্যে যে বিশিষ্টতা ছিল, তখনকার অন্য কোনও হিন্দুস্থানি গানে তা পাওয়া যায় না। এমনটা হতেই পারে যে, তাঁর চেয়ে বড়ো ওস্তাদ তখন ভারতবর্ষে অনেক ছিল। অর্থাৎ, তাঁদের গানের সংগ্রহ ছিল আরো অনেক বেশি, এবং তাঁদের সাঙ্গীতিক কসরতও ছিল বহুসাধনার ধন। তবু, যদুভট্টর মতো সঙ্গীতভাবুক আধুনিক ভারতে আর কেউ জন্মেছে কিনা, এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত নন। কেন? সহজ কথায় জানাচ্ছেন কবি, "ওস্তাদ ছাঁচে ঢেলে তৈরি হতে পারে, যদুভট্ট বিধাতার স্বহস্তরচিত।" 

উত্তরকালে স্নেহাস্পদ দিলীপকুমার রায়কে কবি গল্পচ্ছলে যদুভট্টের অসামান্য প্রতিভার একটি নিদর্শনের কথা শুনিয়েছিলেন। ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য - তিনি যদুভট্টের গানের বড়ো অনুরাগী। একবার তাঁর সভায় আমন্ত্রিত একজন হিন্দুস্থানী ওস্তাদ নটনারায়ণ রাগে একখানি গান শোনালেন। তারপর, যদুভট্টের কাছে তারই জুড়ি একটি নটনারায়ণ গানের প্রত্যাশা করলেন সেই ওস্তাদ। 

আরও পড়ুন
ভেসে এল কান্নার শব্দ, মেয়েকে শেষবার না-দেখেই গাড়ি ঘোরালেন রবীন্দ্রনাথ

যদুভট্টের সে রাগটি জানা ছিল না, কিন্তু তিনি কি দমে যাবার পাত্র? সেই ভরা সভায়, পরদিনই নটনারায়ণ রাগের গান শোনাবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন যদুভট্ট। কীভাবে? ওস্তাদজী গাওয়ার সময় তীক্ষ্ণভাবে সেই রাগের প্রতিটি খুঁটিনাটির খেয়াল রেখেছিলেন তিনি। তাঁর কান এমনই তৈরি ছিল যে, তিনি সেই দিনই রাতে বাড়ি গিয়ে চৌতালে নটনারায়ণ রাগে একটি নতুন গান বেঁধে ফেললেন। পরদিন রাজসভায় এসে সে গান শুনিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে দিলেন সঙ্গীতবিদ্যার বিস্ময় যদুভট্ট।

ঠাকুরবাড়িতে ওস্তাদি গানের এমন আবহাওয়া সত্ত্বেও, বালক রবীন্দ্রনাথ সেদিকে মন দিতে পারেননি। কারোর মধ্যে মাস্টারির ভঙ্গি দেখলেই তিনি পালাই-পালাই করতেন, ধরা-বাঁধা পদ্ধতিতে তাঁকে গান শেখানো প্রায় অসম্ভব ছিল। সঙ্গীতাচার্য যদুভট্ট রবিকে ধরবার চেষ্টা করতেন বটে, কিন্তু রবি তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে দৌড়ে পালাতেন। 

যদুভট্টের ইচ্ছা ছিল বালকদের কানাড়া গান শেখাবেন। বাংলাদেশে সেরকম ওস্তাদ আর জন্মায়নি। তাঁর প্রত্যেক গানের মধ্যে originality বলে একটি ব্যাপার ছিল, যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'স্বকীয়তা'। কিন্তু, চঞ্চলমতি বালক তো তখন তাঁর শিষ্যত্বে আত্মনিবেদন করেনি! প্রৌঢ় কবি পরে কৌতুকের সুরে বলেছেন, "এ ভুল যদি না করতুম, পালিয়ে না বেড়াতুম, তা হলে আজকে তোমাদের মহলে কি নাম হত না?" সেটা হয়ে উঠল না বলেই নাকি তিনি এক কৌশল করতে বাধ্য হয়েছেন, "কবিতার-কাছঘেঁষা সুর" লাগিয়ে দিয়েছেন গানে। এর ফলে লোকের মনে লেগেছ ধাঁধা, কেউ বলছে সুরটিই ভালো, কেউ বলছে কথাটিই বেশ। নিজের গানের বৈশিষ্ট্য ভারী সহজ করে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ- "সুরের সঙ্গে কথা, কবি কিনা। কবির তৈরি গান, এতে ওস্তাদি নেই।" 

আরও পড়ুন
কণিকা-কে রঙের চৌবাচ্চায় ফেলে দিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, ‘শাস্তি’র ব্যবস্থা রবীন্দ্রনাথের

নিজের গানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কবি অকপট। তিনি জানতেন, অনেকেই মনে করেন তাঁর গানের ব্যাপক প্রচলনের ফলে ভারতীয় সঙ্গীত নামক প্রকাণ্ড ব্যাপারটির নাকি ভারী ক্ষতি হয়েছে, অপমানও হয়েছে। কবি নির্দ্বিধায় বলেছেন, "তার কারণ আমার অক্ষমতা।" বাল্যকালে তিনি গান শেখেননি। সে জিনিস সহজে শেখা যায় না, শিখতে কষ্ট হয়। সেই কষ্ট তিনি করতে চাননি। 

ওস্তাদেরা যাই বলুন, বাংলার আমজনতা এতে অপ্রসন্ন নয়। হয়তো ওস্তাদি গানের নকলনবিশি করেননি বলেই, সমাজের সকল স্তরে, সকল উপলক্ষ্যে, সকল মানুষের কাছে এমন ‘ভালোবাসার ধন’ হয়ে উঠেছে রবি ঠাকুরের গান! সে গান শুনতে ক্লান্তি নেই, গাইতে কষ্ট নেই! রবীন্দ্রনাথের গান কেমন, তা হয়তো তাঁর গানের কলি ধার করেই বলা চলে, ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’!

Powered by Froala Editor