লিভারপুলের জয় দেখার জন্য মৃত্যুকেও ঠেকিয়ে রেখেছিলেন ডেভ ইভান্স

‘হোম ইজ হোয়ার দ্য হার্ট ইজ’। লিভারপুলের কিংবদন্তি প্রাক্তন খেলোয়াড় ও ম্যানেজার কেনি ড্যালগ্লিশের দ্বিতীয় আত্মজীবনী ‘মাই লিভারপুল হোম’-এর প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম। হৃদয় যেখানে ঘরও সেখানে। ১৯৭৭-এ স্কটল্যান্ডের সেলটিক এফসি থেকে লিভারপুল এফসিতে এসে বিশ্বফুটবলে একের পর এক নজির গড়েন কেনি, পরবর্তীকালে ম্যানেজার হিসেবেও আসে সাফল্য। ১৯৯০-এ লিভারপুলের রেকর্ড আঠারোতম লিগ আসে তাঁর হাত ধরেই। লিভারপুল হয়ে উঠেছিল তাঁর ঘর। ১৯৯১-এ লিভারপুলের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন কেনি। ২০০৯-এ তৎকালীন লিভারপুল ম্যানেজার রাফা বেনিতেজের অনুরোধে ফের লিভারপুলে ফেরেন তিনি। এবার অ্যাকাডেমির অ্যাম্বাসাডর হিসেবে। দীর্ঘ আঠারো বছর পরে ক্লাবে ফিরেও তিনি বুঝতে পারেন এতটুকুও হারায়নি তাঁর ঘর।       

ঘর হারায়নি তেমনই আরও অনেকের। শুধুমাত্র খেলোয়াড় বা ম্যানেজারই না, একটা ফুটবল ক্লাব যে আরও অনেকের ঘর। কোটি কোটি সমর্থকদের হৃদয়ও যে সেখানেই। কেনি ড্যালগ্লিশের প্রশিক্ষণে আঠারোতম লিগজয়ের পরে লিভারপুল সমর্থকদের জন্য ছিল অন্তহীন প্রতীক্ষার পালা। ইংল্যান্ডের ফুটবল লিগের নাম ও ধাঁচা পাল্টে ১৯৯২ সালে চালু হল এফএ প্রিমিয়ার লিগ। তারপর থেকে শুধুই সমর্থকদের হতাশা। এফএ কাপ, লিগ কাপের মত ঘরোয়া ট্রফি, উয়েফা কাপের মত দ্বিতীয় সারির ইউরোপীয় ট্রফি এসেছে। ২০০৫-এ এসেছে গৌরবের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগও। তারপর থেকে ঘরোয়া ফুটবলেও সাফল্য খুবই কম। কয়েকবার লিগজয়ের একদম কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে দ্বিতীয় হয়ে। তবু স্বপ্ন দেখা থামাননি সমর্থকেরা। বছরের পর বছর হতাশা, চোখের জল এবং বহু রোমাঞ্চকর মুহূর্তকে সঙ্গী করেই  ঘরের মাঠ অ্যানফিল্ড কিংবা বাইরের বিভিন্ন স্টেডিয়ামে গলা ফাটিয়ে দলের সমর্থনে চিৎকার করেছেন, গেয়ে উঠেছেন ক্লাবের বিখ্যাত অ্যান্থেম “ইউ ইউল নেভার ওয়াক অ্যালোন”। তবে শুধুই শহরের বা ইংল্যান্ডের অধিবাসীদের একাংশই নন, রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে হৃদয়ের টানে লিভারপুল ফুটবল ক্লাব ঘর হয়ে উঠেছে দেশবিদেশের বহু সমর্থকেরই। 

২০১৫-এ লিভারপুলের ম্যানেজার হলেন যুর্গেন ক্লপ। যেন জাদুছোঁয়ায় পাল্টে গেল সবকিছু। খেলোয়াড়, সমর্থকদের আত্মবিশ্বাসকে নতুন রূপ দিলেন তিনি, লিভারপুল ছুটল তেজি ঘোড়ার মতো। একটার পর একটা বাধা পার হতে হতে ২০১৯-এ ফের হাতে এল উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। সে বছরই মাত্র এক পয়েন্টের জন্য প্রিমিয়ার লিগ জেতা হল না। কিন্তু হাল ছাড়লেন না কেউই। ফলশ্রুতি? ২০২০-এর ২৬ জুন সাত ম্যাচ বাকি থাকতেই প্রিমিয়ার লিগ হাতে তুলল লিভারপুল। দীর্ঘ তিরিশ বছর পরে ঘরে এল লিগ। অতিমারীর ভয়ঙ্কর সময়েও রাস্তায় বেরিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতলেন শহরের সমর্থকেরা। তৈরি হল ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।

এ ইতিহাসের শরিক শুধু আজকের এই ফুটবল দল ও তার সমর্থকেরাই নন। ম্যানেজার ক্লপের কথায় এই অধ্যায়ের নির্মাণে রয়েছে অতীতের অবদানও। সেখানে যেমন রয়েছেন কেনি ড্যালগ্লিশ, রয়েছেন দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে প্রত্যাশার ভার কাঁধে নিয়ে বেড়ানো অভিশপ্ত নায়ক স্টিভেন জেরার্ড-সহ বহু প্রাক্তন খেলোয়াড় ও কোচ, তেমনই রয়েছেন গ্যালারিতে লাল জার্সিতে ভিড় করা আবছায়ামুখ সারি সারি সমর্থকেরা। যাঁরা এই জয় চাক্ষুষ করলেন শুধুমাত্র তাঁরাই নন, ১৯৮৯-এ হিলসবোরো স্টেডিয়াম দুর্ঘটনায় মৃত ৯৬ জন কিংবা সদ্যপ্রয়াত ‘দ্য রেডস’ সমর্থক– প্রত্যেকেই এই অধ্যায়ের অংশ।  

আরও পড়ুন
বিশ্বসেরারা খেলেননি ক্লাবে, তবু ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ‘সফলতম’ ক্লাব লিভারপুলই

তিরিশ বছর পরে লিগজয়ের উদযাপনের মুহূর্তেই ফিরে দেখা যাক এক লিভারপুল সমর্থকের আশ্চর্য কাহিনি।                  

আরও পড়ুন
তিনটে পা ও ১৬টি আঙুল নিয়েই আমেরিকা মাতিয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক, শিখেছেন ফুটবলও

১ জুন, ২০১৯। নিউজিল্যান্ডের এক হাসপাতালে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন তিনি, আর প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন আরও কিছু ঘণ্টা বেঁচে থাকার! ডেভ ইভান্স, ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি শহরের এক লিভারপুল সমর্থক।

আরও পড়ুন
৬০ বছর আগে ফিরিয়েছিলেন আমন্ত্রণ, চুণীর মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানাল ইংল্যান্ডের সেই ক্লাবই

অথচ, সব ঠিক থাকলে তাঁর সেদিন থাকার কথা ছিল মাদ্রিদের ওয়ান্দা মেট্রোপলিটানো স্টেডিয়ামের কাছে এক হোটেলে। সেবার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে লিভারপুল এক এক করে গ্রুপ স্টেজ থেকে ফাইনালে উঠেছে, আর ডেভ ও তাঁর স্ত্রী লিজ একটু একটু করে টাকা জমিয়েছেন। উদ্দেশ্য একটাই। মাদ্রিদের ফাইনালে মাঠে বসে টটেনহ্যাম হটস্পারস এর বিরুদ্ধে প্রিয় দলের জন্য গলা ফাটানো। সেই মতো বুক করা হয়ে গিয়েছিল মাদ্রিদের এক হোটেলও। কিন্তু জীবন ভেবেছিল অন্যরকম।

আরও পড়ুন
অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক, ডাক পেয়েছিলেন আর্সেনাল ক্লাব থেকেও

এর কয়েক মাস আগে কভেন্ট্রি থেকে ডেভ ও লিজ চলে এসেছিলেন নিউজিল্যান্ডে। আগের চেয়ে আরও ভালোভাবে জীবনকে উপভোগের আশায়। স্বাস্থ্যপরীক্ষায় ধরা পড়েনি কিছুই। তারপর হঠাৎই পেটের অসহ্য যন্ত্রণা! পরীক্ষায় ধরা পড়ল মারণ ক্যানসার, শেষ স্টেজ। সব আশা শেষ! বাধ্য হয়েই হোটেলের বুকিং ক্যানসেল করতে হয়েছিল। জমানো টাকায় শুরু হয়েছিল চিকিৎসা। মাদ্রিদের ফাইনালের তিন সপ্তাহ আগে ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছিলেন, আর দু' সপ্তাহ বেঁচে থাকবেন ডেভ।

সেই সময়সীমা কাটিয়ে বসেছিলেন ডেভ। মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখছিলেন চোয়াল চেপে! যেন একটা উঁচু পাহাড়ের শেষ কিনারে একটা পাথরকে কোনোক্রমে আঁকড়ে ধরে প্রায় শূন্যে ঝুলছে একজন মানুষ, নিচে প্রবল বেগে বয়ে চলেছে জলধারা। হাত ফসকে যাওয়ার সম্ভাবনা যে-কোনো মুহূর্তে। জানা ছিল, হাত পিছলে যাবেই, মৃত্যু আসবেই। কিন্তু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দিনের শেষ সূর্য নিভে যাওয়ার আগে আকাশে, জলে, প্রকৃতির প্রতিটা অঙ্গে যে রং খেলে যাবে সেই দৃশ্য না দেখে যে নিষ্কৃতি মিলবে না! ডেভ ভাবছিলেন, আর একটু বেঁচে থাকতেই হবে, আর একটু শ্বাস বাঁচিয়ে রাখতেই হবে...আর একটু! প্রিয় দলের খেলা যে দেখতেই হবে!

খবর গিয়ে পৌঁছেছিল লিভারপুলের বর্তমান ও প্রাক্তন খেলোয়াড়, কোচ সবার কাছে। ভিডিও বার্তায় তাঁরাও ডেভের শেষ স্বপ্নপূরণের প্রার্থনা করেছিলেন।  

স্বপ্নপূরণ হয়েছিল ডেভের। লিভারপুলও জিতেছিল সেই ফাইন্যাল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এসেছিল ১৪ বছর পরে। আর দুচোখ মেলে প্রিয় দলের জয় দেখেছিলেন ডেভ। মৃত্যুর আগে অবধি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন নিজের ঘরকে। এ যেন এক অন্যরকম ভালবাসার গল্প। যে গল্প হয়তো অমর করে দিয়ে যায় লিভারপুলের আর এক কিংবদন্তি বিল শ্যাঙ্কলির মহার্ঘ্য 'অতিশয়োক্তি'কে- "সাম পিওপল বিলিভ ফুটবল ইজ আ ম্যাটার অব লাইফ অ্যান্ড দেথ, আই অ্যাম ভেরি ডিসঅ্যপয়েন্টেড উইথ দ্যাট অ্যাটিটিউড। আই ক্যান অ্যাশিওর ইউ ইট ইজ মাচ, মাচ মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান দ্যাট।’’ 

৮ জুলাই, ২০১৯, জীবনদীপ নিভে গিয়েছিল ডেভ ইভান্সের।

২৬ জুন ২০২০। তিরিশ বছর পরে প্রিমিয়ার লিগ যখন লিভারপুলের ঘরে এল সুবাসিত সেই ঘরে ডেভও রইলেন প্রবলভাবে। এ ঘর যে কখনওই হারায় না! হৃদয় যেখানে, ঘর তো সেখানেই!

Powered by Froala Editor

More From Author See More