বিশ্বসেরারা খেলেননি ক্লাবে, তবু ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ‘সফলতম’ ক্লাব লিভারপুলই

মেসি, রোনাল্ডো, নেইমারের মতো তারকারা খেলেন না এই লিগে। তবু, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ এখন ভারতবর্ষের ‘মোস্ট ওয়াচড লিগ’। কোনও একটা ম্যাজিক তো নিশ্চয়ই আছে, নাহলে বিশ্বজুড়ে এই লিগের এমন জনপ্রিয়তা কেন! ঠিক এই কথাটাই খাটে লিভারপুলের ক্ষেত্রেও। ইতিহাস খুঁড়েও চমকে দেওয়া বড়ো নামের দেখা সেই অর্থে মিলবে না এই টিমে। তবু, ব্রিটিশ ফুটবল ইতিহাসের সবচাইতে সফল দলটার নাম লিভারপুল। হ্যাঁ, ‘রেড ডেভিলস’ ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের থেকেও সফল লিভারপুলের ‘দ্য রেডস’-রা! এবারের প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়নদের ইতিহাসও কিন্তু নজরকাড়া!

লিভারপুল ক্লাবের বয়স নয় নয় করে হল ১২৭ বছর। ১৮৯২ সালে এভার্টন ক্লাব ভেঙে ক্লাবের জন্ম। ঘরের মাঠ এনফিল্ড। প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাব ১৯০১ সালে। তার তিন বছর পরেই দ্বিতীয় ডিভিশনে অবনমন হয় লিভারপুলের। পরের বছর ফের প্রথম ডিভিশনে প্রত্যাবর্তন এবং চ্যাম্পিয়ন। লিভারপুলের ইতিহাসই এমন।

লিভারপুলের আসল সাফল্যের শুরু যদিও বিল স্যাংকলির আমলে, সাতের দশকে। তাঁর আমলেই প্রথমবার  কোনো ইউরোপিয়ান ট্রফি জেতে লিভারপুল, ১৯৭৩ সালে উয়েফা কাপ। তারপর শুরু হয় বব প্যাসলি-র যুগ। ম্যান ইউতে যেমন ম্যাট বুসবি, লিভারপুলে প্যাসলি ছিলেন অনেকটা তেমনই। প্যাসলি-র ১৩ বছরের কোচিং জীবনে মোট ৯টি ট্রফি জেতে লিভারপুল, যার মধ্যে ৭৭, ৭৮ ও ৮১ সালে জেতা তিনটি ইউরোপিয়ান কাপও আছে। এই ইউরোপিয়ান কাপই নাম বদলে এখন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। ঐ সময়ে লিভারপুলের মতো ইউরোপ-সফল ক্লাব আর একটিও ছিল না ইংল্যান্ডে। 

আশির দশকের শুরুতে বার্সিলোনা আজকের বার্সিলোনা হয়নি। রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, এসি মিলান, ম্যাঞ্চেস্টার, আয়াখস আমস্টার্ডাম, বায়ার্ন মিউনিখদের মটো ক্লাবদের পিছনে ফেলে লিভারপুল তখন ইউরোপ শাসন করছে। ১৯৮৫ সালের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে ব্রাসেলসে জুভেন্টাসের মুখোমুখি হয়েছিল লিভারপুল। ফাইনালে ১-০ গোলে হারল তারা। লিভারপুলের সমর্থকদের উস্কানিতে শুরু হল অশান্তি। ফলাফল, ৩৯ জনের মৃত্যু। শাস্তিস্বরূপ ৫ বছরের জন্য যে-কোনো ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতা থেকে নির্বাসিত হল লিভারপুল। তখন তাদের স্বর্ণযুগ চলছে। এই শাস্তির কোপ না নামলে লিভারপুলের ট্রফি ক্যাবিনেটে 

আরও পড়ুন
প্রত্যাবর্তন স্প্যানিশ ফুটবলের, ১১ জুন থেকে শুরু হতে চলেছে লা লিগা

আরও কয়েকটা ইউরোপিয়ান ট্রফি ঢুকত হয়তো।

আরও পড়ুন
তিনটে পা ও ১৬টি আঙুল নিয়েই আমেরিকা মাতিয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক, শিখেছেন ফুটবলও

এরপর শুরু হল লিভারপুলের খারাপ সময়। ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা থেকে নির্বাসন, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগেও পিছিয়ে পড়ার শুরু। ম্যান ইউতে তখন শুরু হতে চলেছে স্যার ফার্গুসনের জমানা। লিভারপুল শেষবার ইংল্যান্ডের ঘরোয়া লিগ জিতল ১৯৮৯-৯০ সালে। যে বছরটি ‘ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ’ শুরু হওয়ার আগের বছর। অর্থাৎ, এখনও অবধি একবারও ‘ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ’ জেতেনি লিভারপুল। লিভারপুলের শেষবার লিগ-জয়ের সময় ম্যানেজার ছিলেন কিংবদন্তি কেনি ডালগ্লিস। ওটি ছিল লিভারপুলের ১৮তম লিগ খেতাব, যা ওই সময়ে ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ। 

আরও পড়ুন
‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার’ তিনি, জীবনের মতো মৃত্যুকেও ঘিরে রাখলেন নীরবতায়

এখনও অবধি একমাত্র ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডই লিগ খেতাব জয়ের সংখ্যায় এগিয়ে আছে লিভারপুলের থেকে। তাদের লিগ খেতাবের সংখ্যা ২০টি। মাথায় রাখতে হবে, মাঝের ২৮ বছর লিভারপুল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জেতেনি!

আরও পড়ুন
চুণীর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ফুটবল জগৎ; স্মৃতিচারণায় প্রশান্ত, মেহতাব থেকে শিল্টন

কিন্তু, এখনও মোট ট্রফি-জয়ের দিক থেকে লিভারপুল ইংল্যান্ডের সফলতম ক্লাব। ৭ ম্যাচ বাকি থাকতেই দ্বিতীয় স্থানে থাকা ম্যাঞ্চেস্টার সিটির থেকে ২৩ পয়েন্টে এগিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল লিভারপুল। ৩০ বছর পরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জয়ের স্বাদ পেল তারা। তাদের মোট ট্রফির সংখ্যা আজকের পর ৬২টি, ম্যান ইউ-এর থেকেও যা বেশি। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগিতা চ্যাম্পিয়নস লিগ তারা জিতেছে ৬ বার। শুধুমাত্র রিয়েল মাদ্রিদ এবং এসি মিলান তাদের থেকে এগিয়ে। অন্যান্য ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলি অনেকটাই পিছিয়ে তাদের থেকে।

আরও পড়ুন
আবারও মৃত্যুর থাবা, চলে গেলেন কিংবদন্তি ফুটবলার চুণী গোস্বামী

লিভারপুলের সবচাইতে সফল খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন দুই স্কটিশ বিশ্বকাপার—ইয়ান রাশ আর কেনি ডালগ্লিস। ইয়ান রাশ এখনও অবধি লিভারপুলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা (৩৪৬ গোল)। এর অনেকটাই পিছনে স্টিভেন জেরার্ড এবং মাইকেল ওয়েন। 

আরও পড়ুন
ফুটবল ম্যাচ থেকে শুরু আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, ১৯৬৯ সালে ঘটেছিল এমনটাই

সাফল্যের চূড়ায় থাকার সময়ে লিভারপুলের ঘরানা বলতে সবাই বুঝত আক্রমণাত্মক ব্রিটিশ ডিরেক্ট ফুটবলকেই। শক্তিশালী রক্ষণ, জোরালো মিডফিল্ড এবং সুযোগসন্ধানী বড় শরীরের ফরোয়ার্ড—এটাই ছিল লিভারপুলের শক্তি। এই ঘরানাকে সম্বল করেই তারা দুঃসময় কাটিয়ে আলোয় ফিরেছে, ২০০৫ সালে এসি মিলানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। সেই ম্যাচে মালদিনি, ক্রেসপো, সিডর্ফ, কাকা-র এসি মিলানের বিরুদ্ধে ৩-০-এ পিছিয়ে পড়েও রূপকথার প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছিল লিভারপুল। যে প্রত্যাবর্তন হয়ত একমাত্র লিভারপুলের ক্ষেত্রেই সম্ভব, যে প্রত্যাবর্তন বারবার ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় করে দেখিয়েছে তারা।

আরও পড়ুন
'মোহনবাগানি' নবনীতার ফুটবলে-প্রেমেও জড়িয়ে ছিল পিতৃতন্ত্রের দেওয়াল-ভাঙার মধুর স্বপ্ন

দুঃসময়ের মাঝপথেই মালিকানা বদল হল লিভারপুলের। ২০১০ সালে এফেসজি গ্রুপ দায়িত্ব নিল ক্লাবের। ‘মধ্যমানের দল’ তকমা ততদিনে গায়ে জুড়ে বসেছে লিভারপুলের। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যান ইউ, চেলসি, আর্সেনালের থেকে ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একবার দ্বিতীয় হলেও লিগে কোনওমতে চতুর্থ স্থান পেয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার ছাড়পত্র পেয়েই তারা তখন খুশি। দলে স্টিভেন জেরার্ড ছাড়া বিশ্বমানের তারকা প্রায় কেউ নেই। দরকার ছিল এমন একজন কোচের, যিনি লিভারপুলের হৃত গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন।

এইসময়েই, ২০১৫ সালে ক্লাবের কোচ হিসেবে এলেন জার্মান কোচ জুর্গেন ক্লপ। যিনি বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে বুন্দেশলিগা চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন দৈত্য বায়ার্নকে পিছনে ফেলে। ক্লপের আমলে শুরুতেই সাফল্যের হাতছানি। লিগ কাপে রানার্স হল লিভারপুল। পরের বছর ইউরোপা লিগেও রানার্স। সাফল্য যেন এসেও আসছিল না। কিন্তু, দল গুছিয়ে এনেছিলেন ক্লপ। কুটিনহো, সালাহ, মানে, চেম্বারলিন, ফারমিনহো-র মতো একঝাঁক তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে দলে নিয়ে এলেন তিনি। ‘মধ্যমানের’ লিভারপুল ফের হয়ে উঠল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম দাবিদার। মাঝে কুটিনহো চলে গেছেন বার্সিলোনায়। কিন্তু দলকে ভাঙতে দেননি ক্লপ। নিয়ে এসেছেন ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার অ্যালিসেন এবং ডাচ ডিফেন্ডার ভ্যান ডাইককে। দুজনেই লিভারপুলে খেলার সময়েই নিজেদের জায়গায় বিশ্বসেরা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। ক্লপের ছোঁয়াতেই সালাহ, মানে, ফারমিনহো-রাও হয়ে উঠেছেন অনেক ধারালো।

ক্লপের স্টাইলই হল অত্যন্ত গতিময় আক্রমণাত্মক ফুটবল। যেখানে বিপক্ষ টিমকে তাড়া করে বেরানোই প্রধান কৌশল। সঙ্গে উইং থেকে টানা আক্রমণ এবং ফটো-ফিনিশ। এই ছকেই বাজিমাত করলেন ক্লপ। একসময় ৮ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও গত বছরেও কান ঘেঁষে ফের হাতছাড়া হয়েছে প্রিমিয়ার লিগ, কিন্তু সেই ক্ষত চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল জিতে মিটিয়ে নিয়েছেন ক্লপ। আগেরবার রোনাল্ডো-বেলের রিয়েল মাদ্রিদের কাছে হারতে হয়েছিল ‘প্রিয়’ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে। এবারে টটেনহামকে হারিয়ে ‘ইউরোপ সেরা’-র তকমা ফিরে পেয়েছে তাঁরা। আর এবারে প্রিমিয়ার লিগ খেতাব। তাও এতগুলো ম্যাচ বাকি থাকতেই। ক্লপও হয়তো কিংবদন্তি কোচদের তালিকায় ঢুকে পড়লেন। 

লিভারপুলে কখনোই খেলেননি পুসকাস, জর্জ বেস্ট, মারাদোনা, ক্রুয়েফ, জিদান, মেসি, রোনাল্ডো, প্লাতিনির মতো বিশ্বসেরারা। এই ক্লাব কখনই জন্ম দেয়নি তিকিতাকা বা টোটাল ফুটবলের মতো দুনিয়া কাঁপানো ফুটবল ঘরানার। মূলত ব্রিটিশ ফুটবলারদের প্রাধান্য দিয়েই বারবার দল গড়েছে তারা এবং ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতাতেও বাজিমাত করেছে। ঠিক কোন ম্যাজিকে, রসায়নে লিভারপুল ইউরোপের সফলতম ক্লাবগুলির মধ্যে একটি, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। যেখানে একই ঘরানার ফুটবল খেলেই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বারবার ব্যর্থ হয়েছে ইংল্যান্ড। হয়ত এর উত্তরের ভিতরেই লুকিয়ে আছে লিভারপুলের ‘গ্রেটনেস’।

গত তিরিশ বছরে ম্যান ইউ-চেলসি-আর্সেনালের রমরমার যুগেও কিন্তু ইংল্যান্ডের সফলতম ক্লাব এখনও লিভারপুলই।

Powered by Froala Editor

More From Author See More