‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার’ তিনি, জীবনের মতো মৃত্যুকেও ঘিরে রাখলেন নীরবতায়

প্রতিভা। খুবই অদ্ভুত একটা শব্দ। মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটিয়ে দেয় যা বুঝে ওঠার আগেই বদলে যায় চারপাশের হিসেব। অনেকক্ষেত্রেই প্রতিভা এবং বোহেমিয়ান স্বভাব হাত ধরাধরি করে হাঁটে। বন্ধুত্ব। টান। সম্পর্ক। ছেড়ে যেতে চায় না কিছুতেই একে অপরকে। মেনোত্তি যখন তাকে বিশ্বকাপ দল সিলেকশানের জন্য ডেকে পাঠালেন, তিনি তখন দেশের অপর প্রান্তে পুকুরে মাছ ধরতে ব্যস্ত। উত্তর ছিল, এখন মাছ ধরছি তাই যাব না। জাতীয় দলের সুযোগ হোক বা অন্য কোনো বড়ো ক্লাবের অফার। না মানে না। খামখেয়ালি। উচ্ছৃঙ্খল। খ্যাপাটে। জেদি। এই শব্দগুলোর সঙ্গে অভূতপূর্ব প্রতিভাবান শব্দটাও তাঁর নামের পাশাপাশি হাঁটত৷

সত্তরের দশকের গোড়ার দিক। সেন্ট্রাল কর্ডোবা বনাম এসকালাডার মধ্যে ম্যাচ চলছে। দর্শকদের মধ্যে থেকে উড়ে এল হাহাকার। অনুরোধ। ডবল নাটমেগ করতে হবে। ঠিক কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। বলটা সামনে বাড়িয়েই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাক টার্ন৷ ডবল নাটমেগ কমপ্লিট। গোটা স্টেডিয়াম জুড়ে জয়ধ্বনি। তাঁর নামের জয়োল্লাসের মধ্যে অন্য শব্দ শোনা দুস্কর। কিন্তু সে তখন শান্ত। বিনয়ী। নম্র। অথচ যখন এসি মিলান, জুভেন্টাস, লিওঁর মতো ক্লাব থেকে একের পর এক খেলার অনুরোধ আসছে। সেই প্রতিটা অনুরোধের প্রত্যাখানের মধ্যে কোনোরকম বিনয়ের ছিটেফোঁটাও ছিল না। ছিলো অগাধ দেশপ্রেম আর এক অসম্ভবরকমের আত্মবিশ্বাস ভরা স্বর। যাই হয়ে যাক না কেন, দেশের বাইরে খেলব না। আমি খ্যাতি বা যশের জন্য ফুটবল খেলি না। ভালোবাসার জন্য খেলি। শুধু খেলার জন্য খেলি।

রোজারিও। সেই শহর, যার নাম উচ্চারিত হলেও একটাই নাম মাথায় ভাসে। লিওনেল মেসি। সেই লিওর শহরেরই আরেক হারিয়ে যাওয়া হিরের নাম থমাস কার্লোভিচ। যাকে লিওর চরিত্রেরই অ্যান্টিথিসিস বলা চলে। আর্জেন্টিনা। যে দেশের মাটির পরতে পরতে দারিদ্র্য এবং ফুটবল একসঙ্গে মিশে থাকে। সুযোগের অভাবে রাস্তাঘাটে পড়ে থেকে নষ্ট হয় অসংখ্য মণিমুক্তো। তাদেরই ঘরানার এক ব্যতিক্রমী নিদর্শন হলেন থমাস কার্লোভিচ। এল ট্রিঞ্চে। যার পায়ের দোড়গোড়ায় খ্যাতির হাজার সুযোগ এসে গড়াগড়ি খেলেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন একাকিত্বের পথ।

ঊনিশশো চুয়াত্তর। বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচে রোজারিওয় খেলতে আসা পাসারেল্লা, কেম্পেস সমৃদ্ধ আর্জেন্টাইন জাতীয় দলকে তিন-শূন্যের লজ্জায় ডুবিয়ে দেওয়া দুটো পা, যাঁকে দ্বিতীয় হাফে বেঞ্চে না বসালে খেলতে অস্বীকার করেছিল সমগ্র জাতীয় দল। তিনি কোনোদিন জাতীয় দলের জার্সিই গায়ে তুললেন না। এর জন্য দায়ী কে? এ কি ভাগ্যের পরিহাস নাকি তফাৎ আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গির, তা বুঝে উঠতে হয়তো আমাদের আরও অনেকটা বেশি কাছ থেকে উপলদ্ধি করতে হবে জীবনকে।

উদ্বাস্তু ক্রোয়েশিয়ান পরিবারের এই ছেলে, যাঁর নামে মারাদোনা স্বয়ং বলেছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় কোনোদিন রোজাজিওর বাইরে খেলেননি, তিনি মারা গেলেন এক হাঁটুর বয়সী ছেলের অপদার্থতার স্বীকার হয়ে। সাইকেল চালিয়ে ফিরছিলেন। তাঁর সাইকেল ছিনতাই করে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফুটপাথে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় সেই কিশোর। গুরুতর জখম হন। যা মৃত্যুর দরজা থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি আর। চলে গেলেন গত ৮ মে, নীরবেই।

জীবনের সমস্ত বাধা বিপত্তিকে তুড়ি মেরে ড্রিবেল করে যাওয়া এক অসামান্য প্রতিভার এহেন পরিসমাপ্তি সত্যিই নাড়িয়ে দেয়। নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার জন্য যে সাহসের দরকার তা কি সত্যিই আছে আমাদের? ভাবতে বাধ্য করে। আর তুলে দিয়ে যায় চিরাচরিত একটা প্রশ্ন, স্বীকৃতিহীন প্রতিভার কদর শুধুমাত্র কি মৃত্যু পরবর্তীকালের জন্যই বরাদ্দ থাকবে? যার উত্তর হয়তো আর জানা হবে না সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুকুটহীন সম্রাটের!