নব্বইয়ের দশক, এস পি বালাসুব্রমনিয়ম ও ব্যাকুল এক প্রেমিকের জিজ্ঞাসা

‘মেরে রঙ্গমে রঙ্গনে ওয়ালি'। প্রথম যখন শুনি এই গান, গানের খুঁটিনাটি বোঝার মতো বোধশক্তি জন্ম নেয়নি তখনও। তবুও কিছু স্বর অবচেতনে থেকে যায় আমাদের মধ্যে। কিছু সুর নিজে থেকেই জায়গা করে নেয় মননে এই গানটাও সেইরকমই ছিল! 

'মেরে সাওয়ালোঁকা জবাব দো, দোওওও না..' 

দীর্ঘ সময় ধরে এই লাইনটা রীতিমতো ভাবিয়েছে করেছে দেশের একটা গোটা প্রজন্মকে। ভালোবাসার কাছাকাছি যেতে চাওয়ার প্রথম অনুভূতি দিয়েছে তাদের। একজন গায়ক তখনই অসামান্য হয়ে ওঠেন, যখন সুরের সঙ্গে সঙ্গে গানের ভাবকেও তিনি সম্পূর্ণ আত্মীকৃত করে ফেলেন। মানুষের ভিতরকে তোলপাড় করে দেন কোনো এক মায়াবী জাদুতে। ঠিক সেই কারণেই যখন তিনি 'দোওওও না' বলেন, সেই উত্তর শুনতে চাওয়ার আকুতি নিজের ভিতরেও উপলদ্ধি করতে পারে দেশের প্রতিটা মানুষ। আর তিনি চলে যান সাধারণত্বের অনেক ঊর্ধ্বে, অমরত্বের প্রত্যাশা না করেই!

নব্বইয়ের দশকে ছেলেবেলা কাটানো অধিকাংশেরই তার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে সলমন খানের সিনেমার মাধ্যমে। ‘ম্যায়ঁনে প্যায়ার কিয়া’, ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’, ‘সাজন’, ‘আন্দাজ আপনা আপনা’। তিনি এই সমস্ত সিনেমায় সলমনের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিটি সিনেমার অসাধারণ সাফল্যের পিছনে গানের যে বিশাল বড়ো ভূমিকা ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘দিদি তেরা’ হোক বা ‘ধিক তা না’। কিংবা ‘তুমসে মিলনে কি তমন্না’ কিংবা ‘বহত প্যায়ার করতে হ্যায়ঁ’। তিনি অনবদ্য। তিনি অতুলনীয়।  যদিও হিন্দিতে তাঁর প্রবেশ লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলালের হাত ধরে৷ ‘এক দুজে কে লিয়ে’ ছবির মাধ্যমে। তারপর এ-যাত্রা চলতে থাকে। ‘এ হসি ভাঁদিয়া’ পেরিয়ে, তিনি আমাদের ‘রোজা’-র ভালোবাসায় ডুবিয়ে দেন। ও মারিয়ার তালে তালে স্টেশন পেরিয়ে ভালোবাসার গন্তব্যে পাড়ি দেয় চেন্নাই এক্সপ্রেস। আমরা বিভোর হয়ে থাকি গলার জাদুতে!

তবুও শুধুমাত্র হিন্দি জগতে থেমে থাকলে তাঁর আসল পরিচয় পেয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তাহলে হয়তো দেশের সর্বাধিক জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গায়কের মূল ক্ষমতাকেই অস্বীকার করা হবে। আর তা হলো ভাষার উপর তার দখল। কন্নড়ে শুরু করার পর তামিল, তেলুগু, মালায়লম, হিন্দি এবং বাংলা। প্রতিটা ভাষাতেই তিনি অনবদ্য। এখন যখন অধিকাংশ গায়কের নিজের ভাষাতেই উচ্চারণের সমস্যা হয়, তখন তাদের ফিরে দেখা উচিত একবার এই মানুষটার দিকে। বহুবছর পর যখন সাথী-তে গান গেয়ে তাক লাগালেন মনু, তাঁর গলাতেও পূর্বসূরির ছাপ স্পষ্ট ছিল। ইলাইয়ারাজা, এস জানকী এবং এবং তাঁকে নিয়ে তৈরি ত্রিভুজ ভারতীয় সঙ্গীত জগতের সোনালি ইতিহাসের এক  অবিস্মরণীয় অধ্যায়। সাগর সঙ্গমম, স্বাথী মুত্থম, রুদ্রাবীণা। কার অ্যালবাম কার থেকে কতটা এগিয়ে এই নিয়ে আজীবন তর্ক চললেও তা শেষ হওয়ার নয়।  

এক সম্পূর্ণ গায়কের আদর্শ উদাহরণ বলতে যা বোঝায় এস পি বালাসুব্রমনিয়ম ছিলেন তাই। সমস্তরকম গান অত্যন্ত সাবলীলভাবে গাইতে পারার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে। রোম্যান্টিক হোক, অত্যন্ত ইমোশানাল কিংবা আনন্দের। সিচুয়েশানকে ইমোট করে যারা নিজেদের উজাড় করে দিতে পারতেন সুরের মায়ায়। তিনি ছিলেন সেই সারির শিল্পী। ভারতীয় ক্লাসিকাল সঙ্গীত থেকে ওয়েস্টার্ন মিউজিকের আঙিনায় তিনি অবলীলায় যাতায়াত করতেন। প্রতিটা গানকে নিজের মতো করে তুলতেন অতুলনীয়! 

শিল্পীরা চলে যান। শিল্প থেকে যায়। আজীবন। তিনি হয়তো স্বশরীরে আর নেই আমাদের মধ্যে। তবুও, যখন কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে, জানতে চাইবে তার মনের কথা, সেই ‘জবাব দোওওও না'-র নেপথ্যে থেকে যাবেন তিনি। চিরকাল...

Powered by Froala Editor