খোদ কিশোরকুমার-কে স্টুডিও থেকে বের করে দিয়েছিলেন ও পি নাইয়ার!

সুরের দুটো দিক হয়। মেলোডি এবং রিদম। মেলোডি সুরকে প্রাণ দেয়। ভাবের গভীরতা দৃঢ় করে। আর রিদম দেয় ছন্দ। তাল। লয়। ভারতীয় সঙ্গীত জগতে যদি দ্বিতীয় বিষয়টির কেউ এক এবং একমাত্র সম্রাট হয়ে থাকেন তিনি ওমকার প্রসাদ নাইয়ার৷ তার সুরে মেলোডি আর রিদমের যে মিশ্রণ ঘটত, তা অতুলনীয় বললেও অত্যুক্তি হয় না। কোনোরকম প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা ছাড়া সঙ্গীতের নিয়ম ভেঙেও একের পর কালজয়ী গানের সৃষ্টি করা একজন অসামান্য জিনিয়াস ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব না!

তিনি বোহেমিয়ান পাঞ্জাবী ফোকের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন মিউজিকের এক অনবদ্য ফিউসান ঘটিয়েছিলেন ভারতীয় সঙ্গীতে। ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবহারে তাঁর দখল ছিল অভূতপূর্ব। বিশেষ করে অ্যারেঞ্জিং-এর ক্ষেত্রে। মুখড়া থেকে অন্তরায় প্রবেশের পথে যে পার্ট মিউজিক থাকত, তাও বিভোর হয়ে বসে শুনে যাওয়া যায়। ধরুন, ‘পুকারতা চলা হুঁ ম্যায়ঁ’৷ আপাত অর্থে অসাধারণ প্রেমের গান। দুর্দান্ত মেলোডি। অথচ এর রিদমটা লক্ষ করুন। গানটা শুরুই হচ্ছে রিদমিকভাবে, সন্তুর দিয়ে একটা প্রেমের পথ চলার ছবি এঁকে দিচ্ছেন তিনি। যা সচরাচর প্রেমের গানের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কিংবা ধরা যাক ‘দিওয়ানা হুয়া বাদল’। গানটি শুরু হচ্ছে একটি অসামান্য সেতার দিয়ে এবং তারপরেই একটা বিট শুরু হচ্ছে। রিদম। তারপর আসছে ম্যান্ডোলিন। কিন্তু রিদম থামছে না। এমন অসামান্য একটি মেলোডিয়াস প্রেমের গানে রিদম বজায় থাকছে গোটা গান জুড়ে। এই জিনিস ওপি নাইয়ার ছাড়া কোনোদিন সম্ভব নয়। এবার আসা যাক ‘আও হুজুর তুমকো, আ আইয়ে মেহেরবাঁ’র কথায়। এই গানদুটির মুখড়ার অনন্য অ্যারেঞ্জমেন্ট এবং বিট প্যাটার্ন একই সঙ্গে একজন শ্রোতাকে অনুপ্রাণিত ও প্রলুব্ধ করে তোলে। এমন সিডাকটিভ রিদিমের সঙ্গে মন ভরিয়ে দেওয়া মেলোডির মিশেল ঘটাতে পারতেন একমাত্র তিনি! 

অধিকাংশ গানে ড্রাম ব্যবহার না করেই রিদম ক্রিয়েট করতেন তিনি। নিজের মতো করে। প্রথার বাইরে গিয়ে বার বার সৃষ্টি করতেন নতুন ম্যাজিক। আবার কখনও ‘আপকে হসিন রুখ’-এর মতো গান সৃষ্টি করে পিয়ানোর মায়ায় মন ভিজিয়ে দিতেন আপামর শ্রোতার। জিনিয়াস ছিলেন ও পি নাইয়ার৷ ছিলেন ম্যাজিশিয়ানও। তবে তার সঙ্গে বয়ে বেড়াতেন একজন অসম্ভব মুডি ও খ্যাপাটে মানুষের তকমা। ‘মন মোরা বাওরা’ ঠিকঠাক গাইতে না পারায় কিশোরকুমারকে বার করে দিয়েছিলেন স্টুডিও থেকে। লতাজির সঙ্গে তার মানসিক রেষারেষি আশা ভোঁসলের উত্থানে এক অসামান্য মাত্রা যোগ করেছিল। গীতা দত্তের পর নিজের সমস্ত সেরা গান আশার জন্যই তুলে রাখতেন তিনি। তবে মহম্মদ রফিকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আজ পর্যন্ত কোনো ভারতীয় সুরকারের হয়নি, একথা বলাই বাহুল্য! 

ও পি নাইয়ার ছিলেন জাদুকর। ছিলেন রেবেল। প্রথাগত নিয়মকে বার বার তুড়ি মেরে দূরে সরিয়ে নতুন সৃষ্টির নেশায় ছুটে বেড়াতেন তিনি। সুরের সমুদ্রে ডুবে ডুবুরির মতো খোঁজ করে যেতেন অচেনা মণিমাণিক্যের। তাই তার রিদিমে মিশে যেত দিনের আলো, মেলোডি জন্ম দিত চাঁদের স্নিগ্ধতার। একটা সময় গোটা ভারতীয় সঙ্গীত জগত যখন বিদেশি সুরের প্রাধান্যে মত্ত সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একা, অনন্য হয়ে একের পর এক ম্যাজিকাল সৃষ্টির জন্ম দিয়ে গেছেন তিনি। তারপর একদিন হঠাৎই মিলিয়ে গেছেন আকাশে। আমাদের দিয়ে গেছেন সারাজীবন ডুবে থাকার জন্য এক মায়াবী সুরের সমুদ্র!

Powered by Froala Editor