যুগলবন্দিতে পণ্ডিত যশরাজকে ডাকলেন ভীমসেন যোশী, বলিউডের গানেও মুগ্ধ তামাম শ্রোতা

সাল ১৯৭৩। এক তরুণ টুরিস্ট গাইডের অদ্ভুত কাহিনি নিয়ে ইংরেজিতে সিনেমা তৈরি করেন নির্দেশক রাজা ঠাকুর। ছবির নাম 'বীরবল মাই ব্রাদার'। বেশ মজাদার ছিল প্লট। তরুণ টুরিস্ট গাইড বীরবলের সঙ্গে নানা বিদেশি পর্যটকদের বন্ধুত্ব, ঐতিহাসিক স্থান দেখানোর পাশাপাশি তার জীবনের গল্প শুনিয়ে তাদের আনন্দ দেওয়া, বিভিন্নভাবে টুরিস্ট'দের সাহায্য করা ও তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া নিয়ে ছিল সিনেমার গল্প। ১৯৬৫-তে নির্মিত বিজয় আনন্দের 'গাইড'-এর সঙ্গে এই সিনেমার প্রচুর মিল। সেখানে গাইডের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দেব আনন্দ। 'বীরবল মাই ব্রাদার'-এর নাম-ভূমিকায় ছিলেন মারাঠি স্টেজ অ্যাক্টর শচীন পিলগাঁওকর। এ ছাড়াও সেই ছায়াছবিতে অভিনয় করেছিলেন রজত বাপট, গুলাব মোকসি, হাবিবা রহমান, পুনম বৈদ্য, উইলিয়াম সলোমন, লিলিয়ান ও সতীশ দুভাষী সহ একাধিক শিল্পী। ছবিতে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পান বিখ্যাত মারাঠি সুরকার শ্যাম প্রভাকর। 

প্রভাকর ছিলেন কিংবদন্তি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর ঘনিষ্ঠ। ঠিক করলেন পণ্ডিতজিকে দিয়ে তিনি সিনেমায় একটি ডুয়েট গান গাওয়াবেন। গানটি রাগাশ্রয়ী, কিন্তু পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গান গাইবেন এমন ক্ষমতা ভূ-ভারতে আর কার আছে? সবাই তো আর মান্না দে নয়! ১৯৫৬ সালে 'বসন্তবাহার' সিনেমায় পণ্ডিত'জির সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে বসন্ত রাগে "কেতকী গুলাপ জুঁহী" গেয়ে সাড়া ফেলে দিয়ে ছিলেন মান্না। কিন্তু তিনি তখন অন্য প্রজেক্ট নিয়ে ব্যাস্ত। তাহলে গাইবে কে? চিন্তায় পড়লেন প্রভাকর।

উপায় বাতলালেন যোশীজি স্বয়ং। সাফ জানালেন তাঁর সঙ্গে ডুয়েট গাইবেন তরুণ গায়ক যশরাজ। ভীমসেনের আদেশ শিরোধার্য করে তুরন্ত যোগাযোগ করা হল যশরাজের সঙ্গে। যদিও বলিউডি ফিল্ম মিউজিক থেকে দূরত্ব রেখে চলতে পছন্দ করতেন তিনি, কিন্তু যোশীজির কথা ফেলতে পারেননি ৪২ বর্ষীয় যশরাজ। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ও সুরের বোঝাপড়া ছিল ভীষণ ভালো। তলব পেয়েই বিনা বাক্যব্যয়ে সরাসরি স্টুডিওতে হাজির হন যশরাজ। রেকর্ডিং রুমে ঢোকার সময় ভীমসেনকে জিজ্ঞেস করেন- "আমাকেই কেন নিলেন?" হেসে উঠে ভীমসেন বলেন-"তুমি ছাড়া আর কেউ আছে কি?" পণ্ডিতজি এতটাই ভরসা করতেন যশরাজকে। যোশী'জির অনুরোধে সে ছবিতে তাঁর সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন যশরাজ৷ মালকোষ রাগে "রঙ্গরলিয়া করতো সৌতন কে সাথ"। সে এক ঐতিহাসিক যুগলবন্দি। সিনেমা বিন্দুমাত্র না চললেও যোশী-যশরাজ ডুয়েটের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছিলেন তামাম দর্শক। পরে ভীমসেন বলতেন, "আজও যখন আমি পিছনে তাকাই, শুধু যশরাজকেই দেখতে পাই।"   

তিনি সুর লাগালে স্বর্গ নেমে আসে মর্ত্যে। পাল্টে যায় বাতাসের গতিপথ। মন্দ্রসপ্তকে তাঁর ওঁঙ্কার ধ্বনি সাক্ষাৎ ঈশ্বরদর্শনের সহায়ক বলে মনে করেন ভক্তবৃন্দেরা। এমনই জাদু ছিল মেওয়াতি ঘরানার বিদগ্ধ প্রবাদপুরুষ পণ্ডিত যশরাজের গায়কীতে। তিনি সবৈব অর্থেই 'সংগীত মার্তণ্ড'। আশি বছরের গগনচুম্বী সাঙ্গীতিক জীবনে বহু সম্মান পেয়েছেন তিনি। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের মোড় একাই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন যশরাজ। সারা দেশ তাঁর 'মাতা কালিকা' (রাগ আদানা), 'আল্লা মেহেরবান' (ভৈরব) ও 'হরি ওঁম তৎ সৎ' শুনে আজও মন্ত্রমুগ্ধ। অথচ খুব কম লোক জানেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি খুবই অল্প হলেও বলিউডেও তিনি রেখেছেন তাঁর সাক্ষর। 

১৯৫২ সালে প্রথম পাবলিক কনসার্ট করেন যশরাজ। অথচ স্টেজ শো শুরু হয়েছিল মাত্র সাত বছর বয়সে, ১৯৩৭ সালে। তবে গায়ক হিসেবে নয়, তবলিয়া রূপে। ছোটবেলা থেকেই তবলায় হাতেখড়ি তাঁর। পাশাপাশি চলছিল ভয়েস ট্রেনিং, স্বরসাধনা। ১৯৫২ সালে গায়ক হিসেবে প্রথম পারফরমেন্সেই মাত করেছিলেন যশরাজ। এরপর ক্রমশই বাড়তে থাকে তাঁর খ্যাতি। কিন্তু বলিউডে ব্রেক পাওয়া এত সহজ ছিল না। এর জন্য দীর্ঘ ১৪ বছর অপেক্ষা করতে হয় তাঁকে। যদিও কোনোদিনই সিনেমায় প্লে ব্যাকের কথা ভাবেননি যশরাজ। মার্গ সঙ্গীতের জগতেই ছিল তাঁর দাপুটে বিচরণ। কিন্তু ভাগ্য অন্য কিছু হয়তো ভেবে রেখেছিল। 

১৯৬৬ সালে প্রথম বলিউডে নিজের কণ্ঠদান করেন পণ্ডিত যশরাজ। নির্দেশক ভি শান্তারামের 'লড়কি সহ্যাদ্রি কি'-তে একটি রাগাশ্রয়ী ভজন গাওয়ায় জন্য ডাক পান তিনি। সুরকার বসন্ত দেশাইয়ের সুরে রাগ আহীর ভৈঁরো-তে "বন্দনা করো" গানটি গেয়েছিলেন যশরাজ। দর্শকদের কাছে বিপুল সমাদৃত হয় সেই গান। বলিউড পেল এক নতুন অবিস্মরণীয় কণ্ঠস্বর। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এরপর কেমন যেন উহ্যই থেকে গেছেন যশরাজ। প্রায় সাত বছর পর আবারও তাঁর প্রত্যাবর্তন। রাজা ঠাকুরের 'বীরবল মাই ব্রাদারে' পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর সঙ্গে মালকোষ রাগে তাঁর কালজয়ী ডুয়েট আলাদা করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল তাঁকে। দূর্ভাগ্য, সিনেমাটি তেমন চলায় পরবর্তী কালে এই অসাধারণ সৃষ্টি রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। এরপর সুদীর্ঘ সময় বলিউডে আর কোনো গান তিনি গাননি। ২০০৮ সালে বিক্রম ভাট পরিচালিত হরর মুভি '১৯২০' তে আবারও শোনা যায় যশরাজের কণ্ঠ। কিন্তু এবার একটু অন্য ধারার, রোম্যান্টিক সং-এ হাত মকশো করেন তিনি। আদনান সামির সুরে বেগম পারভিন সুলতানার সঙ্গে জুটি বেঁধে গাইলেন "ওয়াদা তুম সে হ্যায় ওয়াদা"। এমনকি ২০১২ সালে আং লি'র বিখ্যাত "লাইফ অফ পাই"-তেও মাইকেল ডানার সুরে নেপথ্যে আহীর ভৈঁরো রাগে একটি আলাপ গেয়েছিলেন সঙ্গীত মার্তণ্ড। 

আরও পড়ুন
মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়েছেন পণ্ডিত যশরাজ, টোড়ি শুনে দাঁড়িয়ে পড়ত হরিণের দল

১৯৬২ সালে ভি শান্তারামের কন্যা মধুরার সঙ্গে বিবাহ হয় যশরাজের। বিয়ের পর বেশ কিছুদিন তাঁরা কাটিয়ে ছিলেন এই শহর কলকাতাতেই। জীবনের বিভিন্ন সময় বহু বছর এই শহরেই কাটিয়েছেন পণ্ডিত যশরাজ। ৪৬' সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। পরে ৬৩-তে ফিরে যান বম্বেতে। ২০০৯ সালে বিখ্যাত স্বামীর জীবনী নিয়ে একটি ছবিও বানিয়ে ছিলেন মধুরা, নির্মাতা ছিল ফিল্ম ডিভিশন। পরে ২০১০ সালে একটি মারাঠি সিনেমা "আই তুঝা আশীর্বাদ" পরিচালনা করেন তিনি। তাতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন যশরাজ।     

১৯৩০ সালের ২৮ জানুয়ারি হরিয়ানার হিসারে একটি ছোট্ট গ্রাম 'পিলি মণ্ডৌরী' থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল অবশেষে তা শেষ হল ১৭ আগস্ট ২০২০ সালে। মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের নিউ জার্সিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরনিদ্রার দেশে পাড়ি জমালেন মেওয়াতি ঘরানার প্রাণপুরুষ পণ্ডিত যশরাজ। শেষ হল ৯০ বছরের এক অসামান্য সুরেলা সফর। বাবা পণ্ডিত মতিরাম, দুই কৃতি দাদা পণ্ডিত মণিরাম ও প্রতাপ নারায়ণের হাত ধরে শুরু যে যাত্রা, তার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গীতের মাধ্যমে ঈশ্বর লাভের বৃত্তান্ত। এই নব্বই বছরে সৃষ্টি হয়েছে কত ইতিহাস, রচিত হয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের না জানি কত কালজয়ী অধ্যায়, তবু যশরাজ থেকে গেছেন যশরাজই। বিলুপ্ত হতে চলা 'হাভেলী সঙ্গীত' থেকে যশরঙ্গী যুগলবন্দি, ভজনগীত থেকে অশ্রুত বিরল রাগরাগিণী'কে পুনরায় সভা সন্মুখে আনার মতো দায়িত্ব একাই সামলে গেছেন তিনি। পিছনে রেখে গেছেন তৃপ্তি মুখার্জি, সঞ্জীব অভয়ঙ্কর, সাধনা সরগম, কলা রামনাথ, অনুরাধা পড়ওয়ালের মতো প্রথিতযশা ছাত্রছাত্রীদের। পদ্মশ্রী, পদ্ম ভূষণ, পদ্ম বিভূষণ সহ একাধিক সম্মানে সম্মানিত হলেও অগনিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে বরাবর পাথেয় করেছেন তিনি। তিনিই খুব সম্ভবত একমাত্র ভারতীয় গায়ক যার নামে একটি ছোট্ট গ্রহাণু (৩০০১২৮ পণ্ডিত যশরাজ) উৎসর্গ করেছিল 'নাসা'। তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা কিংবদন্তি সমুদ্রের মতই অসীম, অতল, অপারবিস্তৃত।   

জীবনের প্রথম ক্ষণ থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে ঈশ্বরসাধনার অঙ্গ রূপে যিনি দেখে এসেছেন, জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে সেই ঐকান্তিক সমর্পণ থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসেননি যশরাজ। তাই আজও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অজর অক্ষয়। তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু পণ্ডিত যশরাজ-কে নতুন করে চেনার, তাঁর সাঙ্গীতিক জীবন দর্শনকে উপলব্ধি করার চেষ্টা কোনোদিন ফুরবে না।

আরও পড়ুন
প্রয়াত প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত যশরাজ, সাংস্কৃতিক জগতে শোকের ছায়া

যশরাজের তাই শেষ নেই, ক্ষয় নেই। তিনি অমর, চির শাশ্বত, মার্তণ্ড স্বরূপ যার প্রভা যুগ যুগ ধরে লালিত পালিত করবে ভারতীয় মার্গসংগীতের গৌরবোজ্জ্বল সাম্রাজ্য।

Powered by Froala Editor