কৃষ্ণের হোলি খেলা নিয়ে গান লিখলেন নজরুল, রেকর্ডে কণ্ঠ মহম্মদ রফির

আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে - এর বাংলা কী রে, একজন হেসে উত্তর দিয়েছিল, কেন, বসন্ত এসে গেছে। বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে বিখ্যাত প্রবাদের সুরে বলতে হয়, দোলও কি দূরে থাকতে পারে । দোল - যাকে সাধু বাংলায় ইউনিভার্সিটি চত্বরে বলে বসন্তোৎসব। আমাদের অনেকের বাড়িতেই প্রতি বৃহস্পতিবার যে দৈনিক পুজোর চল আছে তাতে লক্ষ্মীর পাঁচালি একেবারে প্রাথমিক বস্তু। আশ্চর্য, এতে প্রথম লাইনই শুরু হচ্ছে, ‘দোল পূর্ণিমার নিশা নির্মল আকাশ/ মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস’… ব্যস, তারপর হোলির হুড়োহুড়ি দূরে থাক, দোল নিয়ে আর একটা অক্ষরও নেই।

এরকম একটা রাবীন্দ্রিক দুষ্টুমির কথা বলি। গোটা গানে ভদ্রলোকের দোল নিয়ে কোন হেলদোল নেই, শেষে লিখেদিলেন – ‘দুজনের কানাকানি কথা, দুজনের মিলন বিহ্বলতা - জ্যোৎস্নাধারায় যায় ভেসে যায় দোলের পূর্ণিমাতে, এই আভাসগুলি পড়বে মালায় গাঁথা, কালকে দিনের তরে, তোমার অলস দ্বিপ্রহরে’। গানটা চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় অসামান্য গেয়েছিলেন, ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে’। গোটা গানে কোথাও দোল নেই ,শেষে গিয়ে… এ যেন তিসরি মঞ্জিল সিনেমায় প্রেমনাথের মতো। গোটা সিনেমায় কেউ জীবনে ভাবেনি প্রেমনাথ ভিলেন।

আরও পড়ুন
সলিলের সঙ্গে এক সোফায় নয় কিছুতেই, মাটিতে বসে গান শিখলেন কিশোরকুমার

বসন্তের আরেকটা গানও মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের। হেমন্তের গলায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। পাঁচের দশকের শেষ থেকে গোটা ছয়ের দশকে হেমন্ত যে গলা নিয়ে রাজত্ব করেছেন, সাতের দশকের একেবারে শুরু অবধি, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ভগবান বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, সেই সময় ওঁর গান শুনলে সব কাজ ফেলে টুল পেতে দুমিনিট বসে যেতেন। যাইহোক গানটা হল, ‘চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন চলে যায়’। এই গানটার দুটো যায়গায় রবীন্দ্রনাথ এমন করেছেন একটা জায়গা হল, ‘পুলকিত আম্রবীথি ফাল্গুনের তাপে’। আরেকটা জায়গায় তারও আগে লিখছেন, ‘গন্ধ সনে হল মন সুদূরে বিলীন’। এই লাইনটার পর অবধারিতভাবে যে কথাটা মাথায় আসে, সেটা হল সুধীন দত্তের, ‘স্মৃতিপিপিলীকা তাই পুঞ্জিত করে/ অমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা/ সে ভোলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে/ আমি ভুলিব না/ আমি কভু ভুলিব না।’

এসব কথা যখন মনে করছি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার এক ছাত্র, আমাদের ভাই-বন্ধু সায়ন, সায়ন বর্মণ মনে করাল, হংসমিথুন সিনেমায় হেমন্ত আর সন্ধ্যার আরেকটা গান, বসন্ত - দোল নিয়ে। ‘আজ কৃষ্ণচূড়ার আবির নিয়ে আকাশ খেলে হোলি/ কেউ জানে না সে কোন কথা মনকে আমি বলি’। বটকৃষ্ণ দে-র কথায় সুধীন দাশগুপ্তের সুরে গীতা দত্তের একটা গান উল্লেখ করতেই হয়, ‘কৃষ্ণচূড়া আগুন তুমি আগুন ভরা গানে/ খুন করেছ শূন্য তোমার গুন করেছ গানে’। খুন শব্দটা বাংলা গানে এরকম আসছে বা গুন শব্দটাও, অখিলবন্ধুর গানটা ছাড়া আর কোনো গান মাথায় আসে?

আরও পড়ুন
শেষ বয়সে গান লিখতে চেয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুরের দায়িত্ব কবীর সুমনের

বাংলা সিনেমাও যে পিছিয়ে আছে, তেমনটা নয়। মুখুজ্জে পরিবার-এ প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় আর নির্মলা মিশ্র গাইলেন ‘আবিরে রাঙাল কে আমায়’। দোল বলতেই যে গানটার কথা মনে পড়ে সেটা, দাদার কীর্তির গানটা। বাংলার দোলের যে নিম্নমধ্যবিত্তের কালচার, পুরোটাই সেখানে উপস্থিত। সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর প্রাণোজ্জ্বল শক্তি ঠাকুর। অবশ্যই আমি ভুলছি না, সুধীন দাশগুপ্তের সুরে, ‘ও শ্যাম যখন তখন খেলো না খেলা এমন/ধরলে আর তোমায় ছাড়ব না’।

ইদানীংকালের বাদুড়ে রঙের বাইরেও দোলের একটা আলাদা আদুরে রূপ ছিল বাঙালির কাছে। সেদিন পাড়ার গম্ভীরমতো ভদ্রলোককে রং মাখানো যেত। বেলা তিনটে অবধি স্নানের নামগন্ধ না থাকলেও মায়ের হাতেও মারের নামগন্ধ থাকত না। সেদিন শত্রুর সাথেও গলাগলি করা যেত। দশমীর ইছামতীর বুকের মত দোলের দিনটা – এপার ওপার একাকার। হাসি শুধু হাসি নয় সিনেমার একটা সিন মনে এল। রাজলক্ষ্মী দেবী তাঁর পুত্র জহর রায়কে পক্সের টিকে নিতে বললে, জহর রায় বললেন, না থাক, আমাকে দিতে হবে না। আমার জীবনে একবার বসন্ত আসুক। বসন্তের অনুষঙ্গে মানবেন্দ্রের নিজের সুরে শ্যামল গুপ্তের কথায় একটা গান মনে পড়ে গেল আবার, ;সেই ভালো এ বসন্ত নয় এবার ফিরে যাক/ দূরেই তুমি থেকো/ আবার কোনো বসন্ত দিন তোমার আরো কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে আমায় দেখো’। মানবেন্দ্র মুখার্জির সুর করা একটা গান নিতে বললে আমি এটা নেব। শিপ্রা বসুর একটা অনবদ্য গান আছে, ‘এ ভাঙা বসন্তবেলায় মন নিয়ে আর কী হবে মনের খেলায়’ - গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় নচিকেতা ঘোষের সুরে।

আরও পড়ুন
গান্ধীজির মৃত্যুতে গান থুড়ি নতুন রাগ বাঁধলেন রবিশঙ্কর

এই সেদিনও, ২০০৩ বা ০৪, শুভমিতা গাইলেন, ‘তোমার কাছে ফাগুন চেয়েছে কৃষ্ণচূড়া’। গৌতম ঘোষালের কথা আর সুরে গানটার অ্যাপ্রোচই আলাদা, একেবারে নতুন। ‘তুমি তাই দুহাত ভরে দিলে আগুন উজাড় করে সে কি তোমার অহংকার!’ এই তো সেদিনও তুমুল হইহই করে রূপঙ্কর সুর করছেন, লিখছেন, কিংশুক চট্টোপাধ্যায়, সৈকত কুণ্ডু, সুমিত সমাদ্দার লিখছেন, রাঘব চট্টোপাধ্যায় গাইছেন - শুভমিতা অনসূয়া মজুমদার গাইছেন - একটা এফ এম স্টেশান অবধি বাংলা গানের জন্যে বরাদ্দ হল।

বসন্ত বলতেই এসবও কেন মনে পড়ল জানি না। অপ্রিয় প্রসঙ্গ উঠলই যখন আরেকটু জিইয়ে রাখি। ভাবা যায় - এক ভদ্রলোক লিখছেন, ‘ব্রজ গোপী খেলে হোরী খেলে আনন্দ নবঘন শ্যাম সাথে’, লিখছেন নামের পেছনে ইসলাম পদবি নিয়ে। আরো আরো পরে আরেক ভদ্রলোক মহম্মদ রফি নজরুলের এ-গানটা রেকর্ড করছেন! ২০২০-তে দাঁড়িয়ে এসব হবে! লিখলেই লেখকের মুণ্ডপাত করার জন্যে লোক তৈরি। শুধু কি একটা গান! ‘আজি মনে মনে লাগে হোরী…’ এরকম অজস্র গান। অবশ্য নজরুলকে দায়ী করলে আব্দুল করিম বা বড়ে গোলামই বা বাদ যান কেন। আর আমাদের ‘চিরশত্রু’ দেশের দুই ভাই সালামত আর নজাকতও তো রয়েছেন!

আরও পড়ুন
১৯টি আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িয়ে যে গান

শ্যামল মিত্রের সুরে গায়ত্রী বসুর একটা গান আছে, ‘এই ফাল্গুন হোক অবসান’… গানটা যদিও খুব একটা জরুরি নয় গায়ত্রী বসুর গলাটা ছাড়া, তবু প্রথমেই শ্যামলের হামিং-এর জন্যেও গানটার উল্লেখ করা জরুরি মনে হল। কবীর সুমন উল্লেখ করেছিলেন অনেক আগে, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরে রম্যগীতির গান- ‘বসন্ত কি এমনি করেই আসে’ — এ-গানটাও শোনার উপায় নেই।

শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের বসন্তকে নাকি বিট করেছিল তাঁর বর্ষার গান। বসন্তের গান ৯০-এর আশেপাশে, আর বর্ষার গান ১১০ এর আশেপাশে। ফলে বসন্তও তাঁর অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে তাঁকে বিড়ম্বনায় ফেলেনি। তবু তো রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘ঝরাপাতা গো বসন্তী রঙ দিয়ে শেষের বেসে সেজেছ তুমি কী এ/ খেলিলে হোলি ধুলায় ঘাসে ঘাসে/ বসন্তেরই চরম ইতিহাসে…’ বসন্তের চরম ইতিহাস কেমন, রবীন্দ্রনাথই বলতে পারেন।

ঋণ- চৈতালি দাস