শৈশবে ডানদিক থেকে বাঁদিকে পড়তেন, পরবর্তীকালে রাজ্যের শিক্ষাসচিব তিনিই

সেটা ১৮৬৫ সাল। একজন বিধবা ভদ্রমহিলা নিজের শ্বশুরবাড়িতে তেমন সুযোগ নেই বলে সে-ভিটে ছেড়ে বাপের বাড়ি ব্রাহ্মণবেড়িয়ার কাছে একটাকা ভাড়া দিয়ে থাকতে শুরু করলেন। কারণ? ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখাবেন। এই ভদ্রমহিলা ছিলেন ভবতোষ দত্তের প্রপিতামহী, অন্নদাদেবী। সালটা খেয়াল করলে দেখা যাবে, পরাধীন ভারতে যাঁরা পরে শিক্ষাচর্চায় খুব নাম করবেন, তাঁরা তখন সত্যিই মায়ের কোলে। 

অধ্যাপক দত্ত জন্মালেন যে বছর, সে বছর বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। চারপাশে পেলেন এমন কিছু মানুষকে, তাঁরা ভবিষ্যতে দেশের প্রয়োজনে প্রাণ অবধি দিলেন। সেসময় নারকোলের ছোবড়া দিয়ে কালি হত। যখন বাংলা শিখতে শুরু করলেন, ওঁর মনে থাকত না অক্ষর বাঁ দিক থেকে ডানদিকে পড়ে, না ডানদিক থেকে বাঁদিকে। সে-অবস্থায় পড়লেন একটি শব্দ - ‘কমিনকই’। পরবর্তীতে যখন ইসলামিয়া কলেজে পড়ান, ওঁর মা বলেন, ইকনমিককে কমিনকই পড়ে (শব্দটা ছিল ইকনমিক ফার্মেসি, হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান) কীভাবে উনি ইকনমিক্স শিখলেন, তাই আশ্চর্য। তবে ডানদিক থেকে বাঁদিকে যে পড়ে, তার ইসলামিয়া কলেজে গতি হবে - এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভেবে দেখলে দেখা যায়, কতখানি মনের জোর থাকলে সে সময়ের একজন মহিলা তাঁর ছোটোছেলের মৃত্যু উপলক্ষে চিঠি দিয়ে অন্য ছেলেকে জানান, ‘তোমরা আছো, তাই আমার কর্তব্য শেষ হয়নি।’ সেই সময়ে একজন মহিলা নিজের ছেলেদের ধরে স্বদেশি ছড়া শেখাচ্ছেন, নিজের পছন্দের কবিতা লিখে রাখছেন খাতায়। সালটা যদি খেয়াল করি, ১৯২০-র এদিক ওদিক হবে। 

বসু বিজ্ঞান মন্দিরে মামার বাড়ি বেড়াতে আসার সূত্রে যেতেন ভবতোষ। তিনি বলছেন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র যত বাচ্চা দেখতেন, কিল–ঘুষি খেতে উপহার দিতেন ওদের। আর যারা একেবারে বাচ্চা দুহাতে শূন্যে তুলে বলতেন রাসবিহারী ঘোষ আর তারকনাথ পালিতের (এঁরা দুজনেই বসু বিজ্ঞান মন্দিরের জন্যে প্রচুর টাকা দেন) ছবি দেখিয়ে, খুব ভালো লেখাপড়া করে অনেক টাকা রোজগার করে এই এঁদের মতো লেখাপড়ার জন্যে দিয়ে দিবি। বাচ্চারা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি করে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ বলে পালাত। পরে প্রেসিডেন্সির দুর্গাগতিবাবুর কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক দত্ত ওঁকে রুক্ষ ও মিতব্যয়ী বলেন। এও উল্লেখ করতেও ভোলেন না, এই দুর্গাগতিবাবু একদিন ট্রেন না চলায় নৈহাটি থেকে সোজা ট্যাক্সি নিয়ে কলেজে চলে এলেন। শ্রীদত্ত উল্লেখ করেন, ‘কলেজে ক্লাস না নেওয়া তখনকার দিনের অধ্যাপকেরা অমার্জনীয় অধর্ম বলে মনে করতেন।’ 

আসলে এক-একজন বয়স্ক লোক এক-একটা ইতিহাস। বয়স্ক লোক ইতিহাসের ধারক বলতেই আগন্তুকের উৎপল দত্তের মুখ মনে পড়ে, যখন তিনি নাতি-কে চন্দ্রগ্রহণ–সূর্যগ্রহণ বোঝাচ্ছিলেন।

স্মৃতি বোধহয় এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে আসে নদীর মতো। একজন লোক যখন বহু কৃতিত্বের অধিকারী হন এবং সে কৃতিত্ব সমাজের কাজে আসে, সে সময়টা একটা গুরুত্বপূর্ণ ।

তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজে - যার নাম হয় পরে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ, তারও পরে যাকে আমরা মৌলানা আজাদ কলেজ নামে চিনি, সেখানে অধ্যাপক দত্ত পড়াতেন ৪৬-এর দাঙ্গার সময়। সেসময় তাঁকে রাস্তায় পৌঁছে দিতেন তাঁর যে ছাত্র - তাঁকে আমরা পরে বঙ্গবন্ধু হিসেবে চিনব। সেকথার সূত্র ধরে ওঁকে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত না করে থাকা যাচ্ছে না, “দাঙ্গা একদিন থামল। এই দাঙ্গায় চোখের সামনে একটা জিনিস প্রমাণিত হল - নিষ্ঠুরতা আর কাপুরুষতায় হিন্দু-মুসলমান সব সমান। একটা ধারণা আমাদের তৈরি করে দেয়া হয়েছিল যে দাঙ্গা করে মুসলমানেরাই, মার খায় হিন্দুরা। ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সূচনা অবশ্য লীগ কর্তৃপক্ষ করেছিলেন - ব্যাপকভাবে তোড়জোড় করে। কিন্তু ক্রমে অবস্থাটা বদলাতে লাগল। আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণের একটা যুক্তি আছে। কিন্তু যেটা দেখা গেল সেটা হল, মুসলমান-প্রধান এলাকায় এলাকায় হিন্দু-নিধন, আর হিন্দুপ্রধান এলাকায় মুসলমান-নিধন।” 

আরও পড়ুন
প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ কাইউম, শোকার ছায়া বাংলাদেশের শিক্ষামহলে

এরপরেই অধ্যাপক দত্ত বলছেন যে, এই দাঙ্গাতেই আমরা শিখলাম অনেকে মিলে কয়েকজনের ওপর অত্যাচার করাতে কোনো দোষ নেই। তারপরেই একটা অসামান্য অবসার্ভেসান, “এই দাঙ্গাতেই পাড়ায় পাড়ায় আধিপত্য পেল তারা - যাদের আমরা আগে বলতাম গুন্ডা, দাঙ্গার সময়ে বলতাম দাদা ভাই আর পরে বলতাম মস্তান। মস্তান রাজ আমাদের হাতেই তৈরি। ১৯৪৬-এর ইতিহাসের সূচনা।” একজন মানুষ যিনি প্রাথমিকভাবে একাধিক কলেজে চাকরি করেছেন, ফিনান্স কমিটিতে ছিলেন, শিক্ষাসচিব ছিলেন রাজ্যের – কাজের বিস্তৃতি দেশে শিলচর থেকে সোনমার্গ, বিদেশে ব্যাংকক থেকে কেপ টাউন। 

এমন একজন কৃতী মানুষের জীবনচরিত লেখা দুরূহ, এ লেখার উদ্দেশ্যও নয় তা। পুনরুল্লেখ প্রয়োজন – সে সময়টা যখন সারাদেশে অগাধ মাঠ-ঘাট, মানুষের জীবনে তুলনামূলক কম জটিলতা, ফলে হিংসার স্থান আরও কম। সংগঠিত হিংসা সবসময়ই ভয়াবহ, বলার উদ্দেশ্য, ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির অসূয়া কমই। সে-সময়টায় একের পর এক মানুষ এলেন, শুধু এলেনই না, দর্শনে–বিজ্ঞানে-সাহিত্যে–খেলাধুলোয় নিজেদের প্রজ্ঞার ছাপ রাখলেন। ভবতোষ দত্ত যখন বেড়ে উঠছেন, ওঁর সঙ্গে স্কুলে দীনেশ গুপ্ত(বিনয়-বাদল-দীনেশ) কলেজে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সহকর্মী হিসেবে পেলেন অধ্যাপনায় বুদ্ধদেব বসু-অজিত দত্ত-বিষ্ণু দে-প্রমথনাথ বিশী। বলাবাহুল্য, সে-সমাজ থেকে আমরা অনেকটা দূর এগিয়েছি(এগিয়েছি কি?)। তবু ফিরে দেখার অভ্যেস মেধাবী ছাত্রের পুরনো পাঠ ঝালিয়ে নেওয়ার মতো সুখকর।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কেন্দ্রের তালিকায় প্রথম দশে যাদবপুর, কলকাতা; স্থান পেল রাজ্যের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও