ছন্দ শেখাবেন বলেছিলেন প্রণবদা, জানিয়েছিলেন বানান শেখার নতুন পদ্ধতিও

কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন। খবরটা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না হয়তো, বয়েস সহ সাম্প্রতিক শারীরিক অবনতির জন্যে। তবু প্রণবকুমারের চলে যাওয়াটা আমার শেষ বাক্যের মতো এতটাও নির্লিপ্তির নয়। আমি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়কে চিনতাম, আরো অনেকের মতই চিনতাম প্রণবদাকে। সেই প্রণবদাকে, যিনি রবীন্দ্রনাথের কাঁড়ি কাঁড়ি গান মনে রাখতেন, ভুলে গেলে গীতবিতান দেখে নিতে দ্বিধা শুধু নয়, দেরিও করতেন না। প্রণবদাকে চিনতাম, যিনি বাংলাভাষাকে হাতের তালুর মতো চিনতেন, বুকের দুধের মতো ভালোবাসতেন। প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় কত বড় কবি সেসব কথা বলার সময় আজকে নয়, আর সে বলার মতো কতটা ঠিক লোক আমি, নিজেও জানিনা। তাই সেসব কথায় যাচ্ছি না। যাচ্ছি একটা মানুষের মমত্বের জায়গায়, একাকিত্বের জায়গায়। আমরা যারা ওঁর থেকে অনেকটাই বয়েসে ছোটো, প্রণবদা আমাদেরও একেবারে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। আরও জরুরি যেটা সেটা এই শেষ বয়েসেও শেখার, জানার একটা অদম্য চেষ্টা।

এখনো ফেসবুকের কমেন্ট সেকশনে গেলে ওঁর অজস্র শুভেচ্ছা প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে যেটা পাব, কখনও সরাসরি কখনও প্রচ্ছন্নভাবে বানান শুধরে দেবার চেষ্টা। কিছু মানুষ আছেন, তাঁরা একই সময়ে দুটো কাজের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে জুড়লেও কোনো অসুবিধে হয় না - বরং দুটো কাজই সমানভাবে চালিয়ে যাবার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা রাখেন। আমার বারবার মনে হয়, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় যদি সেতারে বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতের ক্লাস নিতেন - ওঁর ওটা কাজ, কি কাজ নয় সেটা আলাদা প্রসঙ্গ, কিন্তু একইভাবে মনে হয়, যদি উনি স্কুলে বা কলেজে পড়াতেন। বিশেষ করে স্কুলে - কটা প্রজন্ম অন্তত ভালো মাস্টারমশাই পেত, যে ভদ্রলোক সাহিত্য আর গ্রামার দুটোই সহজে বোঝাতে পারেন। আমাকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, একটা বিখ্যাত প্রকাশনা থেকে কৃষ্ণদাস বসুর বর্ণশ্রী বইটা বেরিয়েছিল - আর ছাপে না জানো!

বইটার বিশেষত্ব এই যে, তাতে বাংলার সবকটা ঠিক বানান একেবারে লেখা আছে। আমাদের বানানের বইগুলোয় বাঁদিকে ভুল ডানদিকে ঠিক বানানটা লেখা থাকে। আমরা দুটো বানান একসঙ্গে দেখি, ফলে লেখার সময় কনফিউসড হই। ঐ বইটাতে সেটা ছিল না। বানান শেখার আরো একটা জরুরি পদ্ধতি প্রণবদা বলতেন। আশ্চর্য না - কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বলতেন বলতে হচ্ছে - বলতেন, যে বানানটায় তোমার ভেতর দ্বন্দ্ব থাকবে, আর শেষ অবধি যেটা লিখতে যাবে খাতায় - ঠিক তার উল্টোটা লিখো - দেখবে এতে ৭০ ভাগ বানান ঠিক শিখবে। মানে ওঁর বক্তব্য ছিল - যে একেবারেই জানে না, সে তো ভুলের বেসাতিই করছে, অর্থাৎ ভুলটাকেই ধ্রুব বলে এগোচ্ছে। এবার সে যদি ষ –এর বদলে স লেখে কোথাও – এতে বানান ভুল না করার সম্ভাবনা বেশ খানিকটা বাড়ে।

এই বানানের কথা ওঠায় কতবার আমার দাদুর কথা মনে হয়েছে। দাদু বলত চট্টগ্রামে রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষায় কত লোকের শেখা গড়ে উঠেছে। আমাদের প্রজন্ম আসলেই এঁদের নাম জানে না। জানে না বলেই আমরা দীন। আসলে এই মানুষগুলো সত্যিই একটা প্রতিষ্ঠান। আমার দেখা একমাত্র মানুষ যিনি আমাকে অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের স্মৃতিকথা আটদশক দেখিয়ে বলেছিলেন, এটা পোড়ো। দধিবামন নামে একটা লেখা আছে কী ভালো, পড়ে দেখো। এখন যখন এক দুজন প্রিয়জনকে সে বইয়ের নাম বলি, প্রণবদার মুখ ভেসে ওঠে প্রতিবার নির্ভুলভাবে। আমি নিজে এত স্নেহ পেয়েছি, আমার পক্ষে লিখে বা বলে বোঝানো বৃথা। অরবিন্দ গুহ মারা গেলেন, তাঁর অবিচুয়ারি লিখে আমাকে মেল করেছিলেন। এই অরবিন্দ গুহের নাম কলকাতা শহরে যে কজন মনে রেখেছিলেন, তাঁরা একে একে চলে যাচ্ছেন। বলতেন, “জলের তলায় মস্ত একটা আকাশ ধরি /কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরি হরি…’ অরবিন্দদা কী ভালো লিখেছেন, সোমনাথ ভাবো!”

কী অসামান্য সারল্যের সঙ্গে বলতেন, বলতেন আমি উৎপলের (বসু) কবিতা বুঝি না। আর শোনো গৌতম বসুর কিছু কবিতা আমাকে বুঝিয়ে দিও। এ বলার মধ্যে কোথাও কোনো ভান আর বিদ্রুপ ছিল না। এত অকপট ছিলেন এ-বিষয়ে।

কোনো একটা লেখায় মণীন্দ্র গুপ্তের শিবস্তোত্র বলে কবিতাটা উল্লেখ করেছিলাম। আমাকে বলেছিলেন দেবারতির কবিতা আমার ভালো লাগে, তবে মণীন্দ্রদার লেখা আমার তেমন ভালো লাগেনি। তবে তোমার উল্লেখ করা লেখাটা অনবদ্য। এই যে নত হওয়া, যেটা দরকার সেটার প্রাধান্য দেওয়া - এটা গুণী মানুষ ছাড়া হয় না। ব্যক্তিগত জীবনে শোক-তাপ কম পাননি। স্ত্রী-মেয়ে চলে গেলেন। বোনের কাছে বেলগাছিয়ায় এই বয়েসেও ফোঁটা নিতে ছুটতেন। সে এক আনন্দ দেখেছি। বলতেন মামাতো দাদা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা কেউ উল্লেখ করলে খুশি হতেন। একটা খুব জরুরি কথা যেটা নথিভুক্ত থাকা দরকার বলে মনে হয়। বলতেন দেখো, জীবনানন্দ পাঠক পেলেন না বলে আক্ষেপ করি আমরা। এটাও তো ঠিক জীবনানন্দ বুদ্ধদেব বসুর মতো একজন পাঠক পেয়েছিলেন। এটা বলেছিলেন বলে আমার দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু বদলে গেল এ-বিষয়ে। আসলে প্রণবদা যত বড়ো কবি তত বড়ো ভাবুক। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন! শুধু গান নয়, সমগ্র রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ওঁর জানাশোনা ছিল। শুধু তাই না, কোন গানের দুটো সুর আছে, কোন গানের সুর নিয়ে বিতর্ক আছে - এ সব ওঁর মুঠোয় ছিল। খুব স্বাভাবিক, দেশ পত্রিকায় এতদিন রিভিউ করেছেন গান নিয়ে। দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে কিছু দিন গান শিখেছেন।

রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে আধুনিক গানের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেন। তাতে, ঐ আকাশ পরে সুধায় ভরে শৈলেন মুখোপাধ্যায় রেকর্ড করেন, ওটা ঘটনাচক্রে শোনা ছিল না ওঁর। আমি ওঁকে সেটা শোনাতে খুব খুশি হয়েছিলেন। বলতেন গদ্য লেখা শিখো বুদ্ধদেব বসুর কাছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে প্রণবদা অসামান্য একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, আমরা শব্দ খুঁজি, সুভাষদা শব্দ বর্জন করেন। প্রণবদার আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রবল। নিঃস্ব একা মানুষের এটাই হয়তো শেষ সম্বল। দেশ পত্রিকায় কোনোভাবে পাঁচের দশকের কবিদের সঙ্গে ওঁর নাম শেষে প্রমুখ হিসেবে উল্লেখ করায়, কষ্ট পেয়েছিলেন মনে।

আমি চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনতাম দেখে বলেছিলেন, ওঁর একবার চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সামান্য আর সাময়িক ভুলবোঝাবুঝি হয়েছিল। মিটে গেলে বলেছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে, কাছে ছিলে দূরে গেলে দূর হতে এসো কাছে - গানটা শুনলে ওঁর গলায়, সব ভুলবোঝাবুঝি ভুলে যাই। বলতেন ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল, ‘ওরে নতুন যুগের ভোরে/ দিস নে সময় কাটিয়ে/ বৃথা সময় বিচার করে’ গানটা বাজছে। আমরা তখন কত ছোটো! ভাবতাম - এই গানটা কে তৈরি করল আজকের জন্য। রবীন্দ্রনাথের গান এতটাই আধুনিক, পরে বুঝেছি।

আক্ষেপ করতেন, বলতেন অরুণকুমার সরকারের লেখা এখনকার ছেলেমেয়েরা পড়ে না, না! কোনো একটা অনুষ্ঠানে কবি তারাপদ রায় সহ পাঁচের অনেকেই ছিলেন। প্রণবকুমারের পর তারাপদ রায়ের পালা। প্রণবদা উল্লেখ করে গেলেন যাওয়ার আগে, এই যে কবি তারাপদ রায় এসেছেন। এরপর উনি কবিতা পড়বেন। তারাপদ রায় খানিক ক্ষেদ আর খানিক ঊষ্মা নিয়েই বোধয় প্রণবদাকে বলেছিলেন, আমাকে কবি হিসেবে উল্লেখ করে ঠিক করনি। এরপর আমার জোকস এর বই, হাসির বই কেউ কিনবে! প্রণবদা দুঃখ করতেন এ নিয়ে। নিজের কবিতার বিরল পাঠক নিয়েও কি ওঁর খেদ ছিল না! ছিল। তিনি এ-ও জানতেন, পারিবারিক যে দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে গেছেন তিনি সে দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে নিয়মিত কবিতা ছাপা হয়নি তাঁর! তবু যা ছাপা হয়েছে — তাও কি মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে যথেষ্ট না! জানি না! কবি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অনেক পেয়েছি, যেটা পাইনি সেটা হল তাঁর ছন্দজ্ঞান। তা বলে লজেন্সও পাইনি একেবারে। প্রণবদা আমাকে ছন্দ শেখাবেন বলেছিলেন। শিখতে পারলাম না। এই আক্ষেপ একান্তই আমার।