ঠাকুরবাড়ির শখের থিয়েটার ও জোড়াসাঁকো নাট্যশালা

উনিশ শতকে যখন বাংলা থিয়েটারের শুরু, শিক্ষা-সাহিত্য-চিন্তাধারা-রীতিনীতির পরিবর্তন, প্রাচীন-নবীনের দ্বন্দ্ব, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নানা কর্মোদ্যোগের মধ্য দিয়ে উনিশ শতক তখন নবজাগরণের নতুন ইতিহাস লিখছে।  সেই সময় থিয়েটার সদ্য হাঁটতে শিখছে। শুরুটা অবশ্য ইংরেজি থিয়েটার দিয়েই। কিন্তু বঙ্গ থিয়েটারও পিছিয়ে নেই, বিভিন্ন সংস্কৃত নাটককে সঙ্গী করেই এগিয়ে চলেছে। তার মধ্যেও দেখা যাচ্ছে সূক্ষ্ম টানাপড়েন। তবে কলকাতার সব অগ্রগতিতেই যে বাড়িটির অক্লান্ত অবদান রয়েছে, চারিদিকের এই থিয়েটার চর্চার কর্মযজ্ঞের মধ্যে  সেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? তাঁরাও কোমর বেঁধে লেগে পড়লেন থিয়েটার করতে। ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’-র পথচলাও তখন থেকেই শুরু।

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ। থিয়েটারে তখন দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন দত্তের লেখা নাটকের যুগ। বঙ্কিমচন্দ্র তখন একজন উদীয়মান লেখক। রমরম করে চলছে গোপাল উড়ের যাত্রা। এমন একটা সময়েই তৈরি হয়েছিল জোড়াসাঁকো নাট্যশালা। এর আসল পরিচয় অবশ্য ‘শখের থিয়েটার’। তৎকালীন কলকাতায় অনেক ধনী বাড়িতেই এমন থিয়েটার হত। এগুলির উদ্দেশ্য ছিল মূলত বিনোদন। কিন্তু, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির শখের থিয়েটার একটু অন্য ধারার ছিল। 

ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে থিয়েটারের যোগ অবশ্য পুরনো। চৌরঙ্গী থিয়েটার আর সাঁ-সুসি থিয়েটারের সঙ্গে দ্বারকানাথ ঠাকুরের যোগ ছিল। ঠাকুরবাড়ির আরেক শাখা, পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়িতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘শর্মিষ্ঠা’ আর ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক অভিনীত হয়। কিন্তু জোড়াসাঁকোতে এই থিয়েটারের সূত্রপাত নিয়ে একটা গল্প আছে। জোড়াসাঁকো নাট্যশালা জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। গোপাল উড়ের যাত্রা দেখার পর, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইটিং ক্লাবে বসে লুচি-কচুরি খেতে খেতে কিশোর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মাথায় নাট্যশালার ভাবনা আসে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক দিয়েই নাট্যশালার উদ্বোধন করা হয়। অহল্যাবাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিপুল প্রশংসা পান। ব্যস, এবার মহোৎসাহে নতুন নতুন নাটক অভিনয়ের পালা। ভাই গুণেন্দ্রনাথ, বন্ধু কৃষ্ণবিহারী তো ছিলেনই, তার সঙ্গে যোগ দিলেন অক্ষয় চৌধুরী আর যদুনাথ মুখোপাধ্যায়। তৈরি হল ‘কমিটি অফ ফাইভ’। এরপর হল মাইকেলের ‘একেই  কি বলে সভ্যতা’ নাটক। কিন্তু অভিনয়যোগ্য নতুন লোকশিক্ষামূলক নাটক পাবেন কোথায়? এই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, তাঁর বাবা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ছোট। তিনি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কৃষ্ণবিহারী সেন মহাশয় মিলে মাইকেলের  নাটক অভিনয় করার প্ল্যান করছিলেন। খবর গেল গুণেন্দ্রনাথের দাদা গণেন্দ্রনাথের কানে। ডেকে পাঠানো হল তিন বন্ধুকে। প্রথমে ভেবেছিলেন বকুনি খাবেন। কিন্তু বদলে শুনলেন, থিয়েটার তো হবেই, কিন্তু মাইকেলের নাটক নয়। নতুন কিছু করতে হবে। হুকুম হল- কাগজে বিজ্ঞাপন দাও, বহুবিবাহ সংক্রান্ত নাটক যে লিখে আনতে পারবে, তাকে ৫০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। হলও তাই। ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ খ্যাত রামনারায়ণ তর্করত্ন ‘নবনাটক’ লিখে পেলেন পুরস্কার। আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অভিনীত হল ‘নবনাটক’।     

টানা নয় রজনী এই নাটক অভিনীত হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, অক্ষয় মজুমদার প্রমুখ অভিনয়  করেছিলেন। তখনকার দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী মেয়েদের ভূমিকাতেও ছেলেরা অভিনয় করেছিলেন। শোনা যায়, তাঁদের সাজপোশাক এতটাই নিখুঁত হয়েছিল যে সাহেবরা পর্যন্ত তাঁদের মেয়ে ভেবে ভুল করেছিল। সেখানে হয়েছিল আরেক কাণ্ড। প্রথম অভিনয়ের দিন( ৫ই জানুয়ারি, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ) যে সব ছেলেরা মেয়েদের ভূমিকাভিনেতা ছিলেন, অভিনয়ের ঠিক আগেই দর্শকদের মুখোমুখি হবার ভয়ে  তারা গ্রীনরুমে ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন! তাঁদের চাঙ্গা করে তুলেছিলেন পারিবারিক ডাক্তার দ্বারিকবাবু। অক্ষয় চৌধুরী নাকি এত ভয় পেয়েছিলেন যে তাঁকে আর দর্শকের সামনে আনাই যায়নি। নাটক হত বাড়ির বাগানে। আর মেয়েরা দেখতেন জানালার ঘুলঘুলি দিয়ে। নবনাটকের প্রধান চরিত্র গবেশবাবুর চরিত্রাভিনেতা অক্ষয় মজুমদারকে এক বৃদ্ধ দর্শকের কাছে যাচ্ছেতাই কথা শুনতে হয়েছিল – কারণ নাটকে ছিল গবেশের স্ত্রী আত্মহত্যা করবেন, নাটকের রসে বুঁদ বৃদ্ধ ভেবেছিলেন সত্যিই গবেশবাবু তাঁর স্ত্রীকে মেরে ফেলেছেন। 

এরপর বাংলার নাট্যাকাশে উদিত হলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর লেখা ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’ অভিনীত হল বাড়িতে। পরবর্তী নাটক ‘সরোজিনী’। এই নাটক লেখার সময় একটা ঘটনা ঘটেছিল। একদিন বাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সরোজিনী লিখছেন, কখনও নিজে পড়ছেন আবার কখনও অন্যদের পড়ে শোনাচ্ছেন। পাশের ঘরে পড়তে বসেছেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ। নাটকে রাজপুত রমণীদের অগ্নিপ্রবেশ অংশের সংলাপ শুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন- এখানে সংলাপের বদলে গান হলে কেমন হয়? বলতেই যা দেরি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথায় গান লিখে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ-“ জ্বলজ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ/ পরাণ সঁপিবে বিধবা বালা!” অন্য মাত্রা পেল নাটক ‘সরোজিনী’। এই নাটকের যাত্রাও হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে।  এরপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অশ্রুমতী’ নাটক অভিনীত হবে পাবলিক স্টেজে। বাইরের অভিনেতারা অভিনয় করবেন। কিন্তু বাড়ির মেয়েদের নাটক দেখার কী হবে? তখনকার সময় মেয়েদের তো পাবলিক স্টেজে নাটক দেখার দস্তুর নেই। গুণেন্দ্রনাথ বললেন, পুরো বেঙ্গল থিয়েটারটিই একদিনের জন্য ভাড়া নেওয়া হোক। তাতে শুধু পরিবারের লোকেরাই থাকবে। তাহলে বাড়ির মেয়েদেরও থাকতে বাধা নেই। তাই হল। বেঙ্গল থিয়েটারে ঠাকুরবাড়ির সব সদস্যের সামনে অভিনীত হল ‘অশ্রুমতী’ নাটক। স্টেজে আসল সাদা ঘোড়ায় চেপে অভিনেতা ঢুকলেন। মনে হচ্ছিল সবই যেন আসল। কিন্তু নাটকের রসে বুঁদ হওয়া বালক অবনীন্দ্রনাথের হঠাৎ চোখে পড়ল - রাজপুত রমণী অশ্রুমতীর চরিত্রাভিনেতার পায়ে বকলস দেওয়া-বার্নিশ করা জুতো! ব্যস। এইটুকু খুঁতে শিশুর চোখে নাটকের স্বপ্নিল ‘ইলিউশন’ এক লহমায় ভেঙে গেল।      

কিন্তু ১৮৬৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মুম্বাই চলে যাবার পর থিয়েটারে সাময়িক ছেদ পড়েছিল। এরপর ১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অলীকবাবু’ বা ‘এমন কর্ম আর করিব না’ প্রহসন অভিনয়ের মাধ্যমে ঠাকুরবাড়ির থিয়েটার আবার শুরু হয়। এই অভিনয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল- বাড়ির মেয়েরাও নাটকে অংশ নিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথ এই নাটকের ফরাসি গন্ধ দূর করে তাতে দেশীয়ভাব আনেন। যাইহোক, ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ গেলেন বিলেতে। তিনি যখন ফিরে এলেন, ততদিনে বাড়িতে বইছে গীতিনাট্যের হাওয়া। নাটক লেখার আসরে নেমেছেন বাড়ির মেয়েরাও। এবার নাটকে এল নতুন বিষয় - প্রকৃতি। ঘরোয়া আড্ডায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তুললেন আগেকার দিনের বসন্ত উৎসবের প্রসঙ্গ। এরপরেই তাঁর অনুরোধে স্বর্ণকুমারী দেবী লিখে দিলেন ‘বসন্ত উৎসব’ গীতিনাট্যটি। ঋতুকে আবাহন করার উৎসব শুরু হল এই নাটকটি দিয়ে। অভিনয়ে পরিবারের সদস্যরাই। লেখার পর মহড়া। বাড়িরই সদস্যদের সামনে ঘরোয়া মঞ্চে অভিনীত হল ‘বসন্ত উৎসব’। এরপরে হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘মানময়ী’ গীতিনাট্যটি। গবেষিকা চিত্রা দেব তাঁর ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ গ্রন্থে বলেছেন, এই দুটি গীতিনাট্যতেই অভিনয় ও গান করেছিলেন নতুন বৌঠান কাদম্বরীদেবী।  

আরও পড়ুন
ঘুমে আচ্ছন্ন ঠাকুরবাড়ি, গভীর রাতে স্ত্রী-র পাশে বন্ধুকে এনে বসালেন সত্যেন্দ্রনাথ

এরপর রবীন্দ্রনাথ ফিরে এসে বাড়ির হাওয়া বুঝে লিখলেন অপেরাধর্মী গীতিনাট্য ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’। এরপর হল ‘কালমৃগয়া’, ‘রাজা ও রানী’, ‘মায়ার খেলা’, ‘বিসর্জন’। বাল্মীকিপ্রতিভার মতো ঘটনাবহুল নাটক ঠাকুরবাড়িতে আর হয়নি। প্রথম অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ সাজলেন বাল্মীকি ঋষি, হেমেন্দ্রকন্যা প্রতিভা সাজলেন সরস্বতী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবার রইলেন কনসার্টের দায়িত্বে। দর্শকাসনে কেবল বাড়ির লোকেরা নন, হাজির বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, টি. এন. পালিত, রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রমুখের মতো মান্যগণ্য ব্যক্তিরা। প্রতিভাদেবীর গান আর অভিনয়ে দর্শক মুগ্ধ। কলকাতার সংবাদপত্রগুলি তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তার পরেরবার অভিনয়ে তুমুল বৃষ্টিতে স্টেজ ভেঙে হারমোনিয়াম ভিজে একাকার। কিন্তু বাল্মীকি প্রতিভার চতুর্থ অভিনয়ে দর্শক আরো নামজাদা, খোদ লাটসাহেব পত্নী লেডি ল্যান্সডাউন। অত বড়ো করে বাল্মীকিপ্রতিভার অভিনয় আর হয়নি ও-বাড়িতে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বির্জিতলাওয়ের বাড়িতে হত রিহার্সাল। নাটকের হোতা রবীন্দ্রনাথ। লক্ষ্মী সেজেছিলেন ইন্দিরাদেবী। স্টেজে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোষা ঘোড়াকে নামানো হল, আসল তরোয়াল খেলা হল, ডাকাতেরা নাচল কাবুল দেশের হাজারী নৃত্য। আর সঙ্গে স্টেজকাঁপানো গান। হাততালির বন্যা বয়ে গেল। কিন্তু এর মধ্যেই একখানা কাণ্ড হয়ে নাটকের মজা প্রায় মাটি হতে বসেছিল। প্রত্যক্ষদর্শী অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন - বাল্মীকিবেশী রবীন্দ্রনাথ স্টেজে ঢুকে শঙ্খ বাজাতে যাচ্ছেন - তিনি দেখেন, রবিকাকার চোখে সোনার চশমা জ্বলজ্বল করছে! ধরিয়ে দিতেই তড়িঘড়ি খুলে ঠিক সামলে নিলেন। সাহেবসুবোর অকুণ্ঠ প্রশংসা পেল ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’। এরপর রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড টিম করলেন ‘কালমৃগয়া’। এরপর স্বর্ণকুমারীদেবীর সখি সমিতির অভিনয়ের জন্য লেখা হল ‘মায়ার খেলা’। এর অভিনয় হয়েছিল বেথুন কলেজে। অভিনয়ে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ছিলেন সখি সমিতির সম্ভ্রান্তবংশীয়া মেয়েরা।   

এরপরে হল ‘বিসর্জন’ নাটক। সেখানে রঘুপতিবেশী রবীন্দ্রনাথ আবার এক কাণ্ড করলেন। কালীমূর্তি ঠেলে দেওয়ার কথা ছিল, উৎসাহের চোটে ওই ভারী মূর্তি একেবারে দুহাতে উপরে তুলে ধরলেন! আর যায় কোথা, লাগল কোমরে চোট! ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যকেও এই অভিনয় দেখানো হয়। 

‘রাজা ও রানী’ নাটকের গল্পও খুব মজার। এই নাটকে স্বামী ও স্ত্রীচরিত্রগুলিতে অভিনয় করেছিলেন বিপরীত সম্পর্কের মানুষেরা- অর্থাৎ রাজা ও রানী হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ- জ্ঞানদানন্দিনী অর্থাৎ দেওর ও বৌদি আর দেবদত্ত-নারায়ণীর ভূমিকায় ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ- মৃণালিনী অর্থাৎ ভাশুর ও ভ্রাতৃবধূ। এই নিয়ে বঙ্গবাসী সংবাদপত্রে ‘ঠাকুরবাড়ির নতুন ঠাট’ শিরোনামের প্রবন্ধে ফলাও করে ব্যঙ্গ করা হল, কলকাতায় ঝড় বয়ে গেল। কিন্তু নতুন কিছু করতে গেলে এসব নিয়ে ভাবলে কি চলে? সেই নাটক আবার ছদ্মবেশে চুপিচুপি দেখে গেছিলেন এমারেল্ড থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। কিছুদিন পরে ঠাকুরবাড়ির লোকেদের একই নাটক দেখার আমন্ত্রণ করে, তাঁদেরই অভিনয় নকল করে সুন্দরভাবে স্টেজে দেখিয়ে দেন তাঁরা!  

আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনেও হল না কাজ, ঠাকুরবাড়ির শর্মিলাকে অপুর স্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন সত্যজিৎ

এই বাড়ির থিয়েটারে আর একটি মজার বিষয় ছিল, যা সে যুগে মঞ্চসজ্জা বিষয়টিকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছিল।  নাটকের স্টেজ সবসময় রিয়ালিস্টিক করে তোলার চেষ্টা করা হত। অর্থাৎ আসল উপকরণ দিয়ে স্টেজের উপর বনজঙ্গল, গাছপালা, পুকুরঘাট, রাস্তা বানানো হত। একবার বনজঙ্গলে জোনাকিপোকা দেখাতে মালিকে দিয়ে আসল জোনাকি ধরে স্টেজে ছেড়ে দিয়েছিলেন গুণেন্দ্রনাথ। এসব কাজে ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েরাই হাত লাগাতেন। বাল্মীকিপ্রতিভার স্টেজের জন্য আনা হয়েছিল তুলোর বক, কচুবনে বন্য শূকর সম্বলিত সিন আঁকা হয়েছিল। বাগান থেকে  গাছসুদ্ধ মাটি তুলে এনে বানানো হয় জঙ্গল। আর রবিঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’-র সেই বটগাছ তো স্টেজের জঙ্গলের জোগান দিতে দিতেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। টিনের নল দিয়ে বৃষ্টি বানানো হয়েছিল, ছিল শোলার পদ্মফুল আর উটপাখির ডিমের খোলা ও রাংতা দিয়ে সরস্বতীবেশী প্রতিভাদেবীর জন্য সেতার বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।  

ঠাকুরবাড়ি যুগের সঙ্গে চলতে সর্বদা অগ্রণী। তাই নাট্যশালার জন্মলগ্নে তাঁরাও হাত লাগিয়েছিলেন তাকে বহমান রাখতে। শখের থিয়েটার হিসেবে শুরু করলেও সেই তকমা স্বাতন্ত্র্যের কারণে বেশিদিন তাঁদের গায়ে লেগে থাকেনি। নাটকের ‘ফর্ম’ আর ‘কনটেন্ট’ এই দুই ব্যাপারেই তাঁদের অবদান ছিল। যাত্রার স্তর থেকে থিয়েটারকে উন্নীত করতে তাঁরা ফর্মে এনেছিলেন নতুনত্ব- জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক-সামাজিক নাটক থেকে শুরু করে স্বর্ণকুমারী-রবীন্দ্রনাথের অপেরাধর্মী গীতিনাট্য পর্যন্ত। কনটেন্টের ক্ষেত্রে ঠাকুরবাড়ি সর্বদাই ব্যতিক্রমী। পরমুখাপেক্ষী না থেকে নিজেরাই নাটক লেখা-পরিচালনা-অভিনয় করার মধ্য দিয়ে নতুন কনটেন্টের সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, ঠাকুরবাড়ির থিয়েটারের জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে তাঁদের থিয়েটারের ধারাবাহিকতা, যা কি না সমকালীন ধনী পরিবারের স্বল্পস্থায়ী শখের থিয়েটারগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল, তাকেও ধরা যেতে পারে। এছাড়া থিয়েটারের পিছনে তাঁদের সাধু উদ্দেশ্যটিও লক্ষণীয়। শান্তিনিকেতনে যতবার অভিনয় হয়েছে, টিকিট বিক্রির টাকা সমাজকল্যাণে দান করা হয়েছে। তাঁদের এই অভিনব প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিল সমকালকে। থিয়েটারের স্বার্থেই তৈরি হয়েছিল অসাধারণ সব সৃষ্টি, যা বাংলা নাট্যসাহিত্যকেও সমানভাবে সমৃদ্ধ করেছিল।

তথ্যসূত্র-
১) ঘরোয়া- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২) ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব
৩) আজকাল পত্রিকা
৪) আনন্দবাজার পত্রিকা
৫) বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস- দর্শন চৌধুরী

আরও পড়ুন
অলংকার-সমেত প্রতিমার বিসর্জন, এমনই বৈভব ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজোয়

Powered by Froala Editor