ফেলে দেওয়া জিনিসের পসরা, চব্বিশ পরগনার ‘ভাঙ্গা মেলা’ ও চৈতন্যের স্মৃতি

বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে নন-বায়োডিগ্রেডেবেল বর্জ্য, যার অর্থ পরিবেশের এমন বর্জ্য পদার্থ যা প্রাকৃতিক উপায়ে আর নষ্ট করা যায় না। প্রকৃতির বুকে রীতিমতো অভিশাপ হয়ে থেকে যায়। তাই বিজ্ঞানীরা বহুদিন থেকে এগুলোর ব্যবহার কমানোর কথা বলে চলেছেন। বারবার স্লোগান উঠেছে পুনর্ব্যবহারের জন্য। যাতে পরিবেশের বুকে আবর্জনা হয়ে থেকে না যায়।

তবে এই সব তত্ত্বকথা বোঝেন না দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর ব্লকের মানুষেরা। কিন্তু তাঁরা প্রাচীনকাল থেকেই তাঁদের গ্রামে আয়োজন করে চলেছেন এক অদ্ভুত মেলা – ‘ভাঙ্গা মেলা’। যে মেলায় শুধুমাত্র বিক্রি হয় ব্যবহৃত পুরনো ফেলে দেওয়া জিনিস। মজার বিষয়, দুর দূরান্তের গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে সেসব পুরনো অকেজো জিনিস কিনে নিয়ে যান নিজেদের মনের মতো করে ব্যবহার করার জন্য। 

আমাদের ছোটোবেলার রকমারি জিনিসের মতো ঝাঁ চকচকে নয় এই মেলা, মেলেও না কোন দামি খেলনা কিংবা চকচকে নতুন গাড়ি। উল্টে পাওয়া যায় দুনিয়ার যতো স্ক্র্যাপ জিনিসপত্র। বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন নানান নতুন জিনিসকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছি তখন এইসব গ্রামের মানুষেরা এভাবেই পুরনো জিনিসের মধ্যে নিজেদের বিলাসিতা খুঁজে নিচ্ছে আর সামিল হচ্ছে পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনে, নিজেদের অজান্তেই। 

প্রতিবছর জানুয়ারিতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর গ্রামে বসে এই পুরনো জিনিসের মেলা। শোনা যায়, নবদ্বীপ থেকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উড়িষ্যা যাওয়ার সময় মকর সংক্রান্তির দিন এই স্থানে রাত কাটান। সেই সময় থেকে এই মেলার প্রচলন। মূলত গঙ্গাসাগর স্নানের দিন থেকেই বসে এই মেলা। প্রতিবছর একমাস ধরে চলে এই মেলা। এই বছর করোনা আবহের জন্য কিছুদিন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এর মেয়াদ। 

বইপত্র, জামা কাপড়, খাট বিছানা, টেবিল-চেয়ার, ঘড়ি, জুতো, কম্পিউটার, টিভি, পেইন্টিং, ফোন, চার্জার, সাইকেল, ফ্যান, জলের পাম্প ইত্যাদি নানান জিনিস পাওয়া যায়। এমন কোন জিনিস বোধ হয় নেই যা মেলে না এই মেলায়। তবে মজার ব্যাপার সবকিছুই পুরনো, ব্যবহৃত।

আরও পড়ুন
পুজোতেও 'মেলা' নেই, আরও ঘোর অন্ধকারে মেলার দোকানিরা

এই প্রসঙ্গে মেলায় ঘুরতে আসা পলাশ দাস মজা করে বলেন ‘আপনারা শহরের বাবুরা মোবাইলে পুরনো জিনিস অর্ডার করে কেনেন, আমরা তেমনই এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকি।’ হ্যাঁ, মথুরাপুরের ভাঙ্গা মেলা সত্যিই যেন একটি জলজ্যান্ত একটি Ebay কিংবা Quikr. 

এলাকার বেশিরভাগ মানুষ গরিব, প্রান্তিক। কিন্তু তাই বলে কি শহরের মানুষের মতো একটু বিলাসিতার শখ জাগতে পারে না? কিন্তু নেই শহরের মানুষের মতো আর্থিক সম্বল। এদের এদের প্রত্যেকের মুশকিল আসান এই ভাঙ্গা মেলা। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে তারা এই পুরনো জিনিসই বেছে নেন। হ্যাঁ চাকচিক্য নেই বটে, কিন্তু থাকে প্রাপ্তির আনন্দ। 

আরও পড়ুন
আনন্দের অধিকার সবারই, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের নিয়ে মেলা কাটোয়ায়

ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল ২৪ বছরের সেলিমার সঙ্গে। মেলায় তখন পুরনো বেবি ওয়াকারের দরদাম করছিলেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম সদ্য মা হয়েছেন সেলিমা। তাই নিজের ছোট্ট মেয়ের জন্য এই শখ পূরণ। হোক না তা পুরনো, কিন্তু যখন ছোটো ছোটো পায়ে মেয়ে হেঁটে বেড়াবে, সেই আনন্দের নতুন পুরনো হয় নাকি? 

আবার একটি দোকানে খুঁজে পাওয়া গেল সুন্দর সুন্দর পেইন্টিং। জানা গেল কলকাতার কোন এক বনেদি বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হওয়ার সময় সব কিলো দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখান থেকেই পাওয়া সেসব পেইন্টিং এসেছে এই মেলায়। দেখা যাবে কোন এক ছাপোষা শিল্প প্রেমিকের মন ভরাবে সেসব। 

আরও পড়ুন
৩৪ জন প্রকাশক নিয়ে বইমেলার শুরু, মেলা চত্বরেই মারা যান আনন্দবাজারের সম্পাদক

এইসব পুরনো ফেলে দেওয়া জিনিসের ভিড়ে অনেক সময় টুকটাক এক একটি দামি জিনিসও নাকি বেরিয়ে যায়, যার অ্যান্টিক ভ্যালু থাকে চরম। তবে সেসব এই বিক্রেতারা বোঝেন না। কিন্তু বুঝদার লোকেরা এসবের খোঁজে প্রতি বছর হানা দেয় এই মেলায়। মেলায় তেমনই খুঁজে পাওয়া গেল এক যুবককে। পুরনো ছেঁড়া চিঠির গাদায় মগ্ন হয়ে বসে। জিজ্ঞেস করায় জানা গেল পেশায় আর্কাইভিস্ট সেই যুবকের নাম অভিজিৎ ঘোষ। বারুইপুর থেকে তিনি এসেছেন। মেলায় খুঁজে খুঁজে নানান ফেলে দেওয়া চিঠি হাতড়ে বেরাচ্ছেন। ‘কী করবেন এসব দিয়ে?’ জিজ্ঞেস করায় বললেন ‘ঘাঁটাঘাটি করে দেখাই যাক না, পেলেও পেতে পারি কোনো অমূল্য রতন।’ 

কে জানে, যুবকটি সত্যিই অমূল্য রতন পেয়েছিলেন কিনা। কিন্তু এমন মেলাও কি কম অমূল্য? রসিকেরা বলতে পারবেন ভালো...

Powered by Froala Editor