ইয়াস-বিপর্যয়ের মধ্যেই আগামী ঘূর্ণিঝড়ের চিন্তা, সমাধান অজানা সুন্দরবনবাসীদের

ইয়াসের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের পর কেটে গিয়েছে ১২ দিন। এখনও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারেনি সুন্দরবন। বহু জায়গা থেকে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছচ্ছেন মানুষ। দেখা যাচ্ছে গৃহহীন অসহায় মানুষদের ছবি। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা ঠিক কীরকম? এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে আর ঠিক কতদিন লাগবে? এমনই নানা প্রশ্নের উত্তর আজও ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে গিয়েছে।

সুন্দরবনের মানুষের কাছে ঘূর্ণিঝড় কোনো নতুন বিষয় নয়। আয়লা, লায়লা, বুলবুল, ফণী, আমফান সবই দেখেছেন তাঁরা। ঝড়ের প্রাবল্যের দিক থেকে তাদের অনেকেই ইয়াসের দাপটকে হার মানায়। কিন্তু ইয়াসে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তেমন নজির সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি বলেই মনে করছেন অনেকে। আর তার কারণ ঝড়ের সঙ্গে তীব্র জলোচ্ছাস। দিনটা ২৬ মে। ঝড়ের পূর্বাভাস আগেই ছিল। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারে মানুষকে আগেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাইক্লোন সেন্টারে। সুন্দরবনের বহু মানুষ এখনও কাঁচা বাড়িতে বসবাস করেন। ঝড়ের সময় তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু সাইক্লোন সেন্টার। কিন্তু বিপত্তি তৈরি হল অন্য জায়গায়।

ঝড় শেষ পর্যন্ত গতিপথ বদলে আছড়ে পড়ে ওড়িশার উপকূলে। ফলে সুন্দরবনে তার প্রভাব পড়েছে সামান্যই। কিন্তু সেই দিনটা ছিল ভরা কোটাল। ঝড়ের দাপট কমে আসার আগেই জোয়ারের জল ঢুকতে শুরু করে। আর হাওয়ার স্রোতে তা ভাসিয়ে নিয়ে যায় বহু গ্রাম। ২০০টির বেশি নদীবাঁধ ভেঙে গিয়েছিল আগেই। জোয়ারের জল তাই অতি সহজে রাস্তা করে নেয়। ভাসিয়ে নিয়ে গেল চাষের জমি। ধুয়ে নিয়ে গেল বহু বাসস্থান। নোনা জলের প্রভাবে বিস্তীর্ণ চাষের জমি উর্বরতা হারিয়েছে। অন্যদিকে মিষ্টি জলের সঙ্গে মিশে নষ্ট করে দিল পানীয় জলের উৎস। মারা গিয়েছে বহু মাছ। এই মাছই বহু মানুষের আয়ের উৎস। মুখ্যমন্ত্রী মৃত মাছ প্রক্রিয়াকরণ করে খাদ্যযোগ্য করে তোলার পরামর্শ দিলেও তা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন মৎস্যজীবীরা। ফলে এখন প্রশ্নটা সরাসরি জীবিকার।


“এইভাবে চলতে থাকলে মানুষ আর খেতে পাবে না, বাধ্য হয়ে বাইরে কাজ খুঁজতে যাচ্ছে মানুষ। চাষ না করতে পারলে আর কি করবো? কাজ কই? বাইরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।” বলছিছেন ক্যানিং ভাঙনখালি গ্রামের ইব্রাহিম সরদার। সন্দেশখালি ব্লক ২ এর বাসিন্দা বিমল হালদার পেশায় মৎস্যজীবী। জানালেন, এই বন্যায় তার লক্ষাধিক টাকার মাছ নষ্ট হয়ে গেছে। তার গোটা পুকুর, বাড়ি সংলগ্ন অঞ্চলে শুধুই মরা মাছের গন্ধ। সেখানকার প্রায় ৩০ টি গ্রাম জলের তলায়। জীবিকার সন্ধানে হয়তো এঁরা অনেকেই অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভাববেন। এভাবেই হয়তো সুন্দরবনের বাসিন্দারা হয়ে উঠবেন ক্লাইমেট রিফিউজি।

বিমল হালদারের কথায়, “মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যদি সুন্দরবনের বাঁধ গুলিকে কংক্রিট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তাহলে এই বাঁধ ভাঙার বিপর্যয়ের হাত থেকে সুন্দরবন রক্ষা পেতে পারে। বাঁধ ভেঙে সমস্যা সুন্দরবনের নতুন কিছু না, মাটির তৈরি বাঁধগুলি বেশিদিন টিকে থাকতে পারছে না। সামান্য জলস্রোত বা ধাক্কা এলেই ভেঙে পড়ছে।” আজ ইয়াসের তাণ্ডবের পর নয়, সুন্দরবনের মানুষদের দীর্ঘদিনের দাবি কংক্রিটের বাঁধ। যতবার কোনো ঝড়ের দাপট এসেছে, ততবার নতুন করে উঠে এসেছে এই দাবি। যদিও সুন্দরবনের পরিবেশকর্মী এবং ভূগোলের শিক্ষক উমাশঙ্কর মণ্ডল মনে করেন, কংক্রিটের বাঁধের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে মাটির বাঁধ। কিন্তু সেই মাটির বাঁধ হতে হবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি। তার পরিকাঠামোগত উন্নতি ঘটাতে হবে। সেইসঙ্গে বাঁধের ধারে ধারে ম্যানগ্রোভ গাছের বর্ম তৈরি করতে হবে। আর সেইসঙ্গে প্রয়োজন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ।

কিন্তু এই সমস্তকিছুই ভবিষ্যতের প্রশ্ন। বর্তমানে ১২ দিন ধরেও জল নেমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। আপাতত পুরোটা সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তারপর হয়তো আবার নতুন করে বাঁধ তোলার কাজ শুরু হবে। কিন্তু সেই চিরাচরিত পদ্ধতিতে মাটি গেঁথে তোলা নদীবাঁধ কতদিন স্থায়ী হবে? আর নোনা জলে নষ্ট হয়ে যাওয়া জমিতে কি সত্যিই চাষ-আবাদ সম্ভব হবে কোনোদিন? মানুষের কর্মসংস্থানের কী হবে? এমনই নানা প্রশ্ন ও দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে সুন্দরবনকে। উত্তর এখনও অজানা।

Powered by Froala Editor