প্রয়াত আউশউইটজ যুদ্ধে অংশ নেওয়া শেষতম রুশ সৈনিকও

পোল্যান্ডের ওসউইকিম শহর। সেখান মাত্র দু-তিন কিলোমিটার পথ পেরোলেই আউশউইটজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এই গোটা অঞ্চল হয়ে উঠেছিল এক হত্যাপুরী। সেখানে গড়ে উঠেছিল তিন তিনটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। ইহুদিদের ওপর চলত অকথ্য অত্যাচার। হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ১১ লক্ষ ইহুদিকে। তবে শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে নাৎসিদের সেই অন্যতম ঘাঁটি আয়ত্তে আনেন রেড আর্মির সেনারা। প্রাণ বাঁচে বহু ইহুদি বন্দির।

তবে শিবিরের দখল নেওয়া খুব একটা সহজ ছিল না রেড আর্মির পক্ষেও। আউশউইটজের যুদ্ধে সেদিন অংশ নিয়েছিলেন ১২ হাজার রাশিয়ান সেনা। তাঁর মধ্যে প্রাণে বাঁচেন মাত্র ৬৯ জন। এবার চলে গেলেন ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া শেষ সৈনিকও। ডেভিড ডুশম্যান। বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণেই জার্মানিতে গত শনিবার মৃত্যু হয় তাঁর।

১৯২৩ সালে রাশিয়ার ড্যানজিগ শহরে এক ইহুদি পরিবারে জন্ম ডুশম্যানের। বাবা ছিলেন রুশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসক। মা ছিলেন শিশুবিশেষজ্ঞ। জন্ম ড্যানজিগে হলেও, পরবর্তীতে মস্কোতে বড়ো হয়ে ওঠা ডুশম্যানের। তবে চিকিৎসাবিদ্যার দিকে না গিয়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন খেলাকেই। কিন্তু সেটাও হয়ে উঠল না। ততদিনে বিশ্বযুদ্ধ এসে হাজির হয়েছে দোরগোড়ায়। ফলে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই রেড আর্মিতে নাম লিখিয়েছিলেন ডুশম্যান। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন রেড আর্মির বিশ্বস্ত ট্যাঙ্ক-চালক। 

যুদ্ধে একাধিকবার আহত হয়েছেন তিনি। তবে হাল ছাড়েননি। সুস্থ হয়েই বার বার ফিরে এসেছিলেন সেনা শিবিরে। তারপর সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ১৯৪৫ সালের ২৭ জানুয়ারি আউশউইটজে হানা দিল রাশিয়ার বাহিনী। এক কথায় প্রায় অসম্ভবই ছিল সেই যুদ্ধজয়। ক্যাম্পের বৈদ্যুতিক কাঁটা তারের বেড়া পেরিয়ে জার্মান শিবিরে প্রবেশ করাই যে দুঃসাধ্য কাজ। তবে তেমনটাই করে দেখিয়েছিলেন ডুমশ্যান। সেদিনও টি-৩৪ রাশিয়ান ট্যাঙ্কের চালকের আসনে ছিলেন তিনি। কাঁটা তারের প্রাচীর ভেঙে প্রথম আউশউইটজে ঢুকে পড়েছিল তাঁর ট্যাঙ্ক। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রেড আর্মিকে জয় এনে দিলেও, ভয়ঙ্করভাবে আহত হন তিনি। তারপর আর যুদ্ধে ফেরা হয়নি।

তবে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, যুদ্ধ আসলে গুটিকয় মানুষের ক্ষমতাদখলের খেলা। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই তাই ডুশম্যান ইতি টানের সেনাজীবনে। আবারও শুরু হয় খেলাধুলা। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন রাশিয়ার অন্যতম পেশাদার ফেন্সার। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহিলা ফেন্সিং দলের কোচিং করিয়েছেন প্রায় ৩০ বছর। তাছাড়াও একাধিক দেশের জাতীয় দলে ফেন্সিং কোচের ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে। এমনকি তিনি সেরা কোচের স্বীকৃতিও পেয়েছেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির থেকে। 

পরবর্তীতে জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তাঁকে সরব হতে দেখা গেছে বহুবার। ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ইজরায়েলের ক্রীড়াবিদদের ওপর সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় তাঁর কণ্ঠে ঝলসে উঠেছিল প্রতিবাদ। ডুশম্যান নিজেও ছিলেন অত্যন্ত মানবিক। ইহুদি ও রুশ হওয়া সত্ত্বেও অলিম্পিকের মতো মঞ্চে প্রতিপক্ষ জার্মান দলের খেলোয়াড়দের পরামর্শ দিতে পিছনা হননি তিনি। জার্মান ফেন্সার থমাস বাচের স্মৃতিচারণায় একাধিকবার উঠে এসেছে সেই কথা।

কাজের সূত্রেই ৯০-এর দশকে সোভিয়েতের পতনের পর ডুশম্যান রাশিয়া থেকে স্থানান্তরিত হন অস্ট্রিয়ায়। তবে সেখানেও বেশিদিন থিতু হননি। ১৯৯৬ সালে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ওঠেন জার্মানির। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মিউনিখ শহরেই জীবন কাটিয়েছেন ডুশম্যান। ৯৪ বছর বয়স পর্যন্তও তিনি চালিয়ে গেছেন ফেন্সিং-এর কোচিং। প্রতিদিনই তিনি হাজির হতেন মিউনিখের ফেন্সিং ক্লাবে। 

জার্মানির ‘শত্রু’ হয়েও কখন যেন সেই দেশটাকেই আপন করে নিয়েছিলেন ডুশম্যান। এমন একজন রঙিন ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ মিউনিখ শহর। আবেগপ্রবণ ক্রীড়াজগত। সেইসঙ্গে জীবন্ত ইতিহাসের একটি অধ্যায়ও শেষ হয়ে গেল নিঃশব্দেই…

Powered by Froala Editor