জিলিপি বিক্রির ‘নেশা’য়, ৪০ বছর ধরে মেলায়-মেলায় ঘোরেন সোদপুরের পরিমলবাবু

কথায় বলে, কারোর পৌষমাস তো কারোর সর্বনাশ। কিন্তু পৌষমাস বললেই কি সর্বনাশের কথাই সবসময় মনে পড়ে আমাদের? বরং মনে পড়ে পাড়ার মাঠে মাঠে মেলার ছবি। পৌষমেলা— বাঙালির শীতকালের অন্যতম আকর্ষণ। আজকের আধুনিকতার যুগে আজও টিকে আছে এই মেলা। শীতের আমেজে ভাসতে ভাসতে শহর, শহরতলি বা মফঃস্বলে মানুষ ভিড় জমান এখানে। আগের থেকে এখন মেলার রূপ অনেক বদলালেও, বদল হয়নি একটি জিনিসে। মেলায় ঢুকলেই অনেকের চোখ এবং মন যার দিকে চলে যায়। জিলিপি-গজা-নিমকি, যে জিনিসগুলো না থাকলে মেলার আসল চেহারাটাই অনেক সময় গোপনে থেকে যায়।

আমাদের মন যতই প্যাঁচালো হোক না কেন, এই আড়াই প্যাঁচের মিষ্টিটি খেতে অনেকেই বোধহয় অস্বীকার করবেন না। গরম গরম তেলে একমনে প্যাঁচ কষে চলেছেন একজন, আর পরক্ষণেই বড় থালায় সাজিয়ে রাখা হচ্ছে সেই অমৃত। তার পাশেই সার দিয়ে রাখা গজা, নিমকি, বাদাম। যে-কোনো মেলার অতি পরিচিত দৃশ্য এটি। জিলিপি ঠিক কবে বাঙালির আপন হল, তা নির্ণয় করা গবেষকদের কাজ। কিন্তু বর্তমান ঠিক কেমন আছে? যারা এই শিল্পের প্রধান কারিগর, আজকের এই ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে তাঁদের বক্তব্য কী?

বেলঘরিয়ার জনপ্রিয় পৌষমেলায় যেতে যেতে এই কথাগুলোই বারবার মনে হচ্ছিল। আলো কমে আসছে একটু একটু করে। সেই সঙ্গে মেলায় বাড়ছে স্কুল-কলেজ ফেরত মুখ। ঢোকার মুখেই সেই এল ডোরাডো! কড়ায় নতুন করে ভাজা হচ্ছে জিলিপি। থালাতেও পড়ে আছে কিছু। তাঁর সামনে বসে খদ্দের সামলাচ্ছেন এক প্রৌঢ় ব্যক্তি। নাম, পরিমল দাস। নিজে থাকেন সোদপুরে। সঙ্গে যারা কাজ করেন, তাঁদের কারোর বাড়ি চাকদহ, পালপাড়ায়, কেউ বা আবার থাকেন খড়দহে। সবাইকে নিয়ে মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়ান পরিমলবাবু। দীর্ঘ ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি যেন ঠিকরে বেরোচ্ছিল চোখ দিয়ে। খদ্দের সামলে দিব্বি চালিয়ে যাচ্ছিলেন কথা…

খদ্দেরের কথা জিজ্ঞেস করতে অবশ্য খানিক হতাশই হন। গলায় ঝরে পড়ল ক্লান্তি। এখন মেলা অনেক বেড়েছে, ফাঁকা মাঠ পেলেই বসে যাচ্ছে বাঁশের কাঠামো। ঘুরতে হচ্ছে অনেকই। কিন্তু আগে যেমন অনেক লোকে কিনতে আসত, এখন সেই তুলনায় সংখ্যাটা কমেছে। মেলা, বিশেষ করে রথের মেলা, পৌষমেলা মানেই জিলিপি— এই ধারণাটাই এখন কমে আসছে। সেই সঙ্গে কমছে নতুন প্রজন্মের ক্রেতারা। পরিমলবাবু বলেন, “একটা সময় জিলিপি খেতে বয়স্করা তো আসতই, বাচ্চারাও আসত। বায়না করত। আজ আর সেসব কোথায়? সবাই চিপস আর অন্য জিনিস খেয়েই চলে যায়।”

বাজারে প্রতিনিয়ত দাম বাড়ছে জিনিসপত্রের। একপ্রকার বাধ্য হয়েই দাম বাড়াতে হয়েছে জিলিপি-গজার। তবে পরিমলবাবুর একটা আক্ষেপ, এখন যা হয়, সবই রাজনীতি আর ব্যবসাকে মাথায় রেখে। সেই নস্টালজিয়া, সেই একটা টান আজ আর নেই। বেলঘরিয়ার পৌষমেলা শেষ হয়ে গেলে চলে যাবেন কাঁকুড়গাছি। সেখান থেকে আবার অন্য কোনো মেলায়। এই বয়সে এসে সমস্ত জায়গায় ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হন না? এক তুড়িতে উড়িয়ে দেন সোদপুরের পরিমল দাস। এ যে নেশা! এই কাজই তো করে এসেছেন এত বছর, এতে আবার ক্লান্তি! কিন্তু মুখে কি কোথাও লেগে থাকে না একটা চাপা কষ্ট?

বেরিয়ে আসছি, খেয়াল পড়ল দোকানের বিক্রেতাদের জামার দিকে। প্রায় প্রত্যেকের জামাতেই একটা ব্যাজ লাগানো। তাতে লেখা ‘নো এনআরসি, নো সিএএ’। রাজনীতি এবং ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি যে এঁদেরও ছুঁয়েছে, সেটা বোঝা যায়। ওঁরাও বুঝতে পারেন। তাই শেষবারের মতো হাসেন তাঁরা। একসঙ্গে। নতুন ভাজা জিলিপিগুলো রসে টইটম্বুর। সেসব কিনে বেরিয়ে পড়ছে লোকজন। ভিড় বাড়ছে। আরেকবার জিলিপির প্যাঁচ কষার জোগাড় করছেন পরিমলবাবু। সামনে যে খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে!

Latest News See More