সৌরভের সঙ্গে লর্ডসে টেস্ট অভিষেক তাঁরও, ৫ রানের জন্য সেঞ্চুরি অধরা রাহুল দ্রাবিড়ের

সিডনি টেস্ট। হাওয়ার গতিপ্রকৃতিও বিরুদ্ধে। পাশ থেকে অস্ট্রেলিয়ানদের ক্রমাগত স্লেজিং চলছে। স্লিপ থেকে পিচ বরাবর ফিল্ডার রেখে সৃষ্টি করা হচ্ছে অতিরিক্ত চাপ। কখনও ব্রেট লি, কখনও স্টুয়ার্ট ক্লার্কের একটার পর একটা বিষাক্ত ডেলিভারি এসে আছড়ে পড়ছে আর এসে থেমে যাচ্ছে একটা ব্রিটানিয়া ব্যাটের চওড়া দেওয়ালে। সময় এগোচ্ছে, দর্শকদের বু'তে ফেটে পড়ছে স্টেডিয়াম। বোলাররা প্রলোভনের হাজার একটা সুযোগ সাজিয়ে দিচ্ছে পাতে। আর ঠিক তার পরেই প্রতিটা বল গিয়ে লেপ্টে যাচ্ছে মাটিতে। এক, দুই, তিন... একেবারে চল্লিশটা বলের পর যখন একটা সিঙ্গেল নিলেন তিনি, বু'তে ফেটে পড়া গোটা সিডনির প্রতিক্রিয়া বদলে গেল স্ট্যান্ডিং ওভেশানে, আর একটা নতুন মহাকাব্য লেখার দিকে পা বাড়ালেন তিনি...

পৃথিবীর যে-কোনো মহাকাব্যে এমন এক চরিত্র থাকে, যাঁর প্রভাব সম্পর্কে অবগত থাকে না কেউ। মহাকাব্যের প্রভাব-প্রতিপত্তির আলোচনায় তাঁর নামের উপমা অনেকে ভুলে গেলেও, মহাকাল তাঁর কাছে ঋণী থেকে যায়। লাঞ্ছনা, উদাসীনতাকে আগলে নিয়ে তিনি শুধু নিজের দায়িত্ব পালন করে যান। তৎকালীন সমাজ তাঁর উপকারিতা বুঝতে অক্ষম হলেও, ভবিষ্যৎ তাঁর প্রতিটা পদক্ষেপ লিখে রাখে...

নিজের ভালোবাসায় ডুবে থেকেও বাবা, মায়ের ইচ্ছের কদর করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তারপর মাস্টার অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পড়তে পড়তে ভারতীয় দলে ডাক। স্বপ্ন সত্যি হওয়ার সেই শুরু, মাটিতে হাঁটতে-হাঁটতে আকাশকে ছুঁয়ে দেখার হাতছানি। লর্ডসের বুকে টেস্ট অভিষেক, কিন্তু পাঁচ রান বাকি থাকতেই থেমে যাওয়া। বদলে, নায়ক হিসাবে কোনো এক বাঁহাতি বাঙালির আবির্ভাব।

জীবনের প্রথম পাঁচদিনেই তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, জনপ্রিয়তা আসুক বা না-আসুক তাঁর কাজ তাঁকে করে যেতে হবে। জনস্রোতে তাঁর নামের জয়ধ্বনি উচ্চারিত না হোক, ক্রিকেটের মহাকাব্যের প্রতিটা অধ্যায়ে নিজের ছাপ ফেলে যেতে হবে। আর সেদিন থেকেই শুরু হয় লড়াই। জনপ্রিয়তার মায়াজালকে হারিয়ে কর্মযজ্ঞে জিতে যাওয়ার লড়াই, যশের নেশায় না জমে ২২ গজকে প্রেমিকা বানানোর লড়াই। আর এই অসম লড়াই চলতে থাকে, জিততে থাকেন তিনি। পাণ্ডুলিপিতে লেখা হতে থাকে জয়গাথা, যার কোনো অধ্যায়ে ২৮১-র আড়ালে ঢেকে যাওয়া ১৮০। অন্যদিকে, রাওয়ালপিন্ডির অবিশ্বাস্য ২৭০। শেষ অধ্যায়ে জ্বলজ্বল করে অ্যাডিলেডের ২৩৩ রানের সোনালি আভা...

টেস্টের বহমানতা ওয়ান ডে ক্রিকেটেও বজায় থাকে। এখানেও চলতে থাকে সেই অসম লড়াই, আর সঙ্গে এসে যুক্ত হয় এক বাড়তি দায়িত্ব। দলে ভালো উইকেটরক্ষকের অভাবে তিনি হাত তুলে নেন সেই গুরুভার। নিজের অসাধারণ ফিল্ডিং দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে হয়ে উঠলেন দেশের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক। ২০০-র উপর ক্যাচ এবং স্ট্যাম্পের পরিসংখ্যান যে ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে। তার সঙ্গে জুড়ে রইল টনটনের ১৪৫, ব্রিস্টলের ৬৩ বলে ৯৩, নিউজিল্যান্ডের ১৫৩-র মতো কিছু ছোটোখাটো মণিমুক্তো।

তবু, তিনিও তো মানুষ। নামের, খ্যাতির মোহে শেষমেশ ধরা দিয়ে দিলেন, আর সাক্ষী থাকলেন অধিনায়ক হিসাবে এক ভয়াবহ বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতার। ক্রিকেট জীবন শেষ করলেন কিছুটা গ্লানি নিয়ে, যা তাঁর সাফল্যে পাশে ছোটো ছোটো কলঙ্কের চিহ্নের মতো। জ্যোৎস্নার আলোর মতো রেখে গেলেন টেস্টে তেরো হাজার আর ওয়ান ডে-তে দশ হাজারের উপর রান, সমস্ত টেস্ট খেলিয়ে দেশের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির রেকর্ড, সর্বাধিক পার্টনারশিপে অংশগ্রহণ করার গরিমা(৭৩৮), ৮৮টা ১০০র বেশি রানের পার্টনারশিপের অংশীদারি...

না, তিনি ঈশ্বর নন। তিনি স্পেশালও নন। তিনি সবার থেকে আলাদা। সাধারণ অথচ অনন্য। তাই তো দেশের অনূর্ধ্ব ১৯ দলের দায়িত্ব নিয়েও ফাইনালে তুলেও হেরে যেতে হয় তাঁকে। রাজস্থান রয়্যালসে যুক্ত থেকেও তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলতে একফোঁটাও ভয় পান না। তাঁর তালিমে অজিঙ্ক রাহানের খেলাই বদলে যায়। যোগ্যতা নেই বলে সাম্মানিক পিএইচডি ফিরিয়ে দেন। হ্যাঁ, তিনি সাধারণ থাকতে ভালোবাসেন। ভুল করেন, স্বীকার করেন। সেটাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যান, আবার কাজে ডুব দেন। প্রচারের থেকে দূরে থেকে যান আজও। সত্যিই তিনি ঈশ্বর নন, স্পেশালও নন, তিনি বাস্তব, তিনি রুক্ষতা, তিনি আশা, তিনি শক্তি। আর, পৃথিবীর সবরকম বাধার বিরুদ্ধে দেওয়াল হয়ে রুখে দাঁড়ানোর সাহস...

আজ সেই সাহসেরই জন্মদিন। যাঁর নাম রাহুল ‘দ্য ওয়াল’ দ্রাবিড়...