ট্রাক ড্রাইভার, শ্রমিক থেকে পর্দার ‘জেমস বন্ড’; শন কনেরি ও এক অতিমানবিক আখ্যান

ভাগ্য বা অদৃষ্ট যাই বলেই ডাকা হোক না কেন, যদি পৌঁছে যাওয়ার বাসনা থাকে তা মানুষকে পৌঁছে দেয় কাঙ্খিত লক্ষ্যে। কিতনি সিদ্দতসে ম্যায়ঁনে তুমহে পানেকি কোশিস কিহি হ্যায়, কে হর জররে নে মুঝে তুমসে মিলানেকি শাজিস কিয়ি হ্যায়। অল্প বয়সে স্কটল্যান্ডের রুক্ষ রাস্তার বুক পেরিয়ে বাড়ি বাড়ি দুধ দিয়ে আসত যে কিশোর, তার রুপোলি পর্দার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শো-ম্যান হিসাবে পদার্পণ করার যাত্রাটাও অনেকটা সেরকমই!

কিছুটা বড়ো হতেই অর্থ রোজগারের জন্য ব্রিটিশ নেভিতে যোগদান। কিন্তু শারীরিক সমস্যার জন্য বেশিদিন কাজ করা হল না। অগত্যা এডিনবরায় ফিরে আসা। জীবনধারণের জন্য করতে শুরু করলেন বিভিন্ন কাজ। কখনও ট্রাক ড্রাইভার তো কখনও লাইফগার্ড। কখনও শ্রমিক তো আবার কখনও কফিন পালিশার। মিঃ ইউনিভার্স বডিবিল্ডিং কনটেস্টেও করে ফেললেন অংশগ্রহণ। এর সুবাদেই পার্ট টাইম আর্টিস্ট মডেল হিসাবে এডিনবরা কলেজ অফ আর্টে পাওয়া গেল একটা কাজ।

ভাগ্যের চাকাটা ঘুরতে শুরু করল এখান থেকেই। কয়েকবছর টেলিভিশনে আর সিনেমায় বেশ কিছু সাপোর্টিং রোলে অভিনয় করার পর তাঁর টেবিলে এসে পড়ল ‘ডক্টর নো’-এর স্ক্রিপ্ট। ইয়ান ফ্লেমিং তাঁকে দেখার পর যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তাঁর লিখিত এমন অতিমানবীয় ম্যানারিজমের মানুষটাকে এমন মাটিতে লেপ্টে বড় হওয়া একটা ছেলে  বিন্দুমাত্র ফুটিয়ে তুলতে পারবে কি না। বাকিটা ইতিহাস...

ফ্লেমিং-এর বন্ডকে নিজের করে নিয়েছিলেন শন কনেরি। তাকানো, কথা বলা, মুচকি হেসে সিগারেট ধরানো থেকে এক মুহূর্তে  মহিলাদের নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে নেওয়া। প্রতিটা অভিব্যক্তিতে, প্রতিটা সিনে শন ছিলেন অনবদ্য। রুপোলি পর্দার প্রথম বন্ড হিসাবে সেই চরিত্রের আবেদনকে যে জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন শন, তা অতুলনীয়। যে-কোনো জিনিস প্রথম করতে এগিয়ে আসার দুটো দিক থাকে। এক, সাফল্য এলে আপনি চিরকালের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে যাবেন। আর দুই আপনি অসফল হলে আপনার দেখানো পথেই আপনার করা ভুল শুধরে নিয়ে অন্য কেউ হয়ে উঠবে নায়ক। শন সেই ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। বলা ভালো নিতে পেরেছিলেন। তার বেড়ে ওঠা, জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি এই চরিত্রের মধ্যে দেখতে পেয়েছিল অমর হয়ে যাওয়ার রসদ। 

শুধুমাত্র বন্ড হিসাবেই নয়, অন্যান্য চরিত্রে অভিনেতা হিসাবে নিজের অসামান্য অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেছেন শন। এনট্র্যাাপমেন্টে যৌন টানাপোড়েন ফুটিয়ে তোলা থেকে দ্যা আনটাচেবেলসে রুক্ষ, টাফ আইরিশ পুলিশ সবেতেই সমান সাবলীল ছিলেন তিনি। ইন্ডিয়ান জোনসে, তার পিতার চরিত্রেও ছিলেন অদ্বিতীয়। বন্ডকে সরিয়ে নিলেও অভিনেতা শন আলাদাভাবেই থেকে যাবেন সমস্ত সিনেপ্রেমীদের বুকে! 

জীবনে এখন যা হচ্ছে, আর পরে যা হবে আমরা ভাবি তার মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু যোগাযোগ থেকে যায়। স্টিভ জবস তার স্পিচে বলেছিলেন ফিল ইন দ্যা ডটসের কথা। পিছন ফিরে তাকালে, বোঝা যায় প্রতিটা পদক্ষেপের মাহাত্ম্য। ছোটোবেলা থেকে অসংখ্য কাজ সমান পারদর্শিতার সঙ্গে করতে পারার যে স্বভাব তৈরি হয়েছিল, তাই হয়তো নিজেকে ভার্সাটাইল প্রমাণ করার শক্তি যুগিয়েছে তাঁকে। অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, তাদের সঙ্গে কথাবার্তার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় তাকে হয়তো সাহায্য করেছে পর্দার বন্ডকে আরও জীবন্ত করে তুলতে। যার ফল আমরা দর্শক হিসাবে ভোগ করেছি বারবার! 

আরও পড়ুন
প্রয়াত শন কনেরি, উল্টে গেল জেমস বন্ডের একটি পাতাও

কিছু মানুষের জীবন, জীবন থেকে রূপকথা হয়ে যায়। কিছু মানুষ, সাধারণ থেকে অতিমানবীয় ওঠেন। আর এইভাবেই আমরা জানতে পারি একদা, সেক্স অ্যাপিল কম থাকার দরুণ বন্ড চরিত্র থেকে বাদ পড়তে বসা এক তিরিশ বছরের তরুণ কীভাবে ঊনষাটতম বয়সে এসে সেক্সিয়েস্ট ম্যান অ্যালাইভের শিরোপা অর্জন করেন!

Powered by Froala Editor