‘বাংলার সোনু সুদ’ হিসেবে নয়, নিজগুণেই পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দেব

লকডাউন। প্রায় তিন মাস ধরে আমরা গৃহবন্দি। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এর সঙ্গে দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই চালিয়ে গেলেও বেঁচে থাকা ক্রমশ দুর্বিসহ হয়ে উঠছিল আরও অসংখ্য মানুষের। তারা শ্রমিক। পরিযায়ী। কর্মসূত্রে, সামান্য অর্থের আশায় যারা পা বাড়িয়েছিল বাড়ি থেকে অনেক দূরে। বাবা। মা। ছেলে। মেয়ে। ছোট্ট একটা স্বপ্ন। আরও একটু বেশি ভালো থাকার ইচ্ছে। তার জন্যই এত পরিশ্রম। নিমেষেই যেন সব ভেসে গেল। তিন মাস ধরে কাজ নেই। অর্থ নেই। নেই থাকার ঠিকঠাক জায়গা। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। খালি পেট৷ খালি পা। রক্তাক্ত। তাও কদম কদম বাড়ায়ে যা। বাড়ি ফিরতে হবে। কিছু মানুষের মৃত্যু মাঝপথেই। জামলো মাকদম। বয়স বারো। একশো কিলোমিটারের পর আর পারল না। এসব দেখে অনেকের সঙ্গে চোখের জল ফেললাম আমরাও। ফিরিয়ে দেওয়ার বাসনা ছাড়া আর কোনোরকম ক্ষমতা যে নেই আমাদের।

এগিয়ে এলেন একজন। সোনু। যার নামে নিজের সদ্যজাত ছেলের নাম রাখলেন এক মা। শুধু পদবিটা সুদ হল না। এভাবেই আরও অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিককে বাড়ি ফেরালেন তিনি। ফেরাচ্ছেন। নিজের চেষ্টায় বাস রেডি করে, খাবার সরবরাহ করে, তাদের সঙ্গে নিজে দেখা করে বিদায় জানাচ্ছেন। বাড়ি ফিরছে কিছু হতাশায় ডুবে যাওয়া মুখ। কোনো মা ফিরে পাচ্ছে তার ছেলেকে। কোনো বাবা যত্ন করে তুলে রাখছে তার ছোট্ট মেয়ের আলিঙ্গন। আমরা কান্না ভুলে আনন্দের হাসি হাসছি। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছি আমাদের আদরের ছেদি সিং-কে৷ 

সম্প্রতি জানা গিয়েছে একই পথে হেঁটেছেন সাংসদ দীপক অধিকারী। আমাদের দেব। নেপাল বর্ডার থেকে ৩৬ জন পরিযায়ী শ্রমিককে বাড়ি ফিরিয়েছেন তিনি। পেশায় তারা সকলেই ছিলেন স্বর্ণকার। এদের মধ্যে বাঁকুড়া, আরামবাগ আর অনেকজন ঘাটালের বাসিন্দা রয়েছেন। এই খবর জানতে পেরে তাদের ফেরাতে উদ্যোগী হন দেব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমতি নিয়েই ৩৬ জন পরিযায়ী শ্রমিককে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। ৩৬ জনের মধ্যে দুই মহিলা আছেন যারা অন্তঃসত্ত্বা। এই মুহূর্তে জম্মু-কাশ্মীর নেপালে আরো অনেক পরিযায়ী শ্রমিক আটকে আছেন যাদের বাড়িতে ফেরানোর জন্য চেষ্টা করছেন তিনি। এ কাজের জন্য যেমন প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন অধিকাংশ মানুষই, তখন একদল মানুষ বলে উঠছেন ‘বাংলার সোনু সুদ’। ভালো কাজের ঋণ হিসাবে ফিরে পাচ্ছেন তুলনা। 

আমাদের সমাজের সমস্যা হল, আমরা তুলনা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারি না। ছোটোবেলা থেকে অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে নিজের বাড়ির ছোট্ট ফুলটাকে তুলনা করে তার ভিতটাকেই নষ্ট করে দিই। আমরা প্রতিভার লালন পালনের থেকেও তাকে ধ্বংস করতে আরও বেশি সিদ্ধহস্ত চিরকাল। সোশাল মিডিয়ায় এ-জিনিস আরও বাড়ে। একদিকে সোনু কিংবা দেব যখন সোশাল মিডিয়াকেই হাতিয়ার করে বাড়িতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তাদের প্রিয় মানুষটিকে, তখন আমরা সেই সোশ্যাল মিডিয়াতেই কে কার দেখে এই অসাধ্য সাধন করল, সেই নিয়ে তর্ক করছি। কিছু করার ইচ্ছে যাদের থাকে, তাদের এসব তুলনা কোনোদিনও থামিয়ে দিতে পারে না একথা যেমন সত্যি। ঠিক একইভাবে সত্যি, যতদিন আমরা নিজেরা সামান্য উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো বচসা বসাব, ততদিন আমাদের উদ্ধারকার্যের জন্য কোনো না কোনো সোনু সুদ কিংবা দেবকেই এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া আমাদের আর কোনো গতি নেই!

Powered by Froala Editor