মাত্র ২২ বছর বয়সে ঘোষণা ‘আমিই আমেরিকা’, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার মহম্মদ আলি

সময়টা ১৯৬৪ সাল। মাত্র ২২ বছরের এক সুঠাম তরুণ, সারা শরীরে ততদিনে ফুটে উঠেছে পৌরুষের চিহ্ন। কিন্তু ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি। মিয়ামি স্টেডিয়ামে বক্সিং রিংয়ে দাঁড়িয়ে কসিয়াস ক্লে সামনে ভিড় করে আছে সংবাদপত্রের চিত্রগ্রাহকের দল। তখন হয়তো কেউ ভাবতেও পারেনি, বিশ শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় পুরুষ হিসাবে বিবেচিত হবে এই তরুণ।

ক্লে অবশ্য তখনই আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। শুধুই কি আত্মবিশ্বাস? নাকি একধরণের বিদ্রোহও? সেদিন রিংয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে ঘোষণা করেছিল, 'আমিই আমেরিকা'। হ্যাঁ, একজন কালো চামড়ার আমেরিকান। আমেরিকা বললে স্বাভাবিকভাবে যাঁদের কথা মনে আসে না সচরাচর, তাঁদের প্রতিনিধি। কিন্তু তাঁরাই তো সে-দেশের অর্ধেক। অথচ তেমন স্বীকৃতি মেলেনি কোনোদিন। বিশ শতকের আমেরিকার ইতিহাস সেই কালো চামড়ার মানুষদের ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। প্রকৃত নাগরিকের অধিকার দাবি করার ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসে অবশ্যই মনে রাখতে হয় মহম্মদ আলির নাম। মিয়ামি স্টেডিয়ামে পথচলা শুরু যে কসিয়াস ক্লে-র, সেই পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়ে উঠবে ‘মহম্মদ আলি’ নামে।

আমেরিকার গড়ে ওঠার ইতিহাসে সাদা চামড়ার মানুষদের সঙ্গে সমান অবদান রেখে গিয়েছেন কালো চামড়ার মানুষরা। তাঁদেরই শরীরের রক্তে-ঘামে ভিজে উঠেছে মাটি। কিন্তু বদলে পেয়েছেন শুধুই লাঞ্ছনা আর অবহেলা। ভোটাধিকার তো এসেছে অনেক পরে। কিন্তু তাও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে। কালো চামড়ার মানুষদের সামাজিক মেলামেশা, আচার ব্যবহার সবই নিয়ন্ত্রণ করত সাদা চামড়ার শাসকরা। এমনকি তাঁরা কোন কোন পার্কে খেলতে যাবেন, তাও বেঁধে দেওয়া হত। লুইসভিল শহরে এভাবেই কেটেছে ক্লে-র ছেলেবেলা। কিন্তু এই ভাগ্যকে জয় করার অঙ্গীকার ছিল সেদিন থেকেই। বাবা বলতেন, একমাত্র অর্থই ভাগ্য বদলে দিতে পারে। ক্লে তাই জানতেন, তাঁকে অনেক অর্থ উপার্জন করতে হবে। কিন্তু আমেরিকাতে একজন সাধারণ কালো চামড়ার মানুষ তখন যেসব কাজ পেত, তাতে তো তেমন স্বপ্ন দেখা যায় না। ক্লে তাই বেছে নিলেন এক অন্য জীবিকা। ১২ বছর বয়স থেকে শিখতে শুরু করলেন বক্সিং।

একমাত্র বক্সিংয়ের রিংয়েই ঘুচে যায় বিদ্বেষের সীমারেখা। একজন সাদা চামড়ার পুরুষের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে একজন কালো চামড়ার পুরুষ। মুখে অনায়াসে মারতে পারে এক ঘুঁষি। এর জন্য তাঁকে কোনো আইনি বা সামাজিক নির্যাতনের মুখে পড়তে হয় না। তাই বক্সিং রিংয়ে কালো চামড়ার মানুষদের ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছিল বিশ শতকের শুরু থেকেই। জো লুইস বা জ্যাক জনসনের মতো বক্সাররা তখন সাদা চামড়ার মানুষদের কাছে মূর্তিমান ত্রাস। কিন্তু ক্লের স্বপ্ন ছিল একটু অন্যরকম। তিনি দাবি করেছিলেন স্বাধীনতা। আর তার জন্য ব্যবহার করেছিলেন নিজের কেরিয়ারকে।

মিয়ামি স্টেডিয়ামে আত্মপ্রকাশের কিছুদিন পরেই ক্লে পরিচিত হবেন মহম্মদ আলি নামে। আমেরিকা ছাড়িয়ে তাঁর নাম পৌঁছে যাবে পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্তে। সৌজন্যে অবশ্যই প্রযুক্তির নবতম অবদান, টেলিভিশন। আর এই জনপ্রিয়তার সূত্রেই আলি প্রচার করবেন একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য। সেদিন সেগুলো বিতর্কিত বলে বিবেচ্য হলেও, আজ তা বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মন্ত্রের মতো। বিশ শতকের রাজনীতিতে নানাভাবে আমেরিকা সরকার বাধ্য হয়েছিল কালো চামড়ার মানুষদের অধিকারে স্বীকৃতি দিতে। আর তার মধ্যে একটা কারণ ছিল অবশ্যই মহম্মদ আলির জনপ্রিয়তা। তিনি ততদিনে অনেকের কাছেই ভগবানের দ্বিতীয় অস্তিত্ব। 

আলির ধর্মাচরণ অথবা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অবশ্য বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু আমেরিকার রাজনীতিতে সাম্যের পতাকা উড়িয়েছিলেন তিনিই। আজ তাই জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনা তাঁর অভাবই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। অথবা প্রতিবাদী জনতার মিছিলের শেষ ভাগে হয়তো অলক্ষে হেঁটে যাচ্ছেন আলি। বলছেন, আমেরিকা মানে শুধুই সাদা চামড়া নয়। বলছেন, বিভিন্নতার সঙ্গে অভ্যস্ত হও।

Powered by Froala Editor

More From Author See More