খেলা দেখাতে দেখাতেই ‘বন্ধু’কে হত্যা, ডলফিন ও তার ট্রেনারের করুণ গল্প

সামনেই বিশাল বড়ো পুল, চারিদিকে অপেক্ষা করে আছেন দর্শকরা। এমন সময় হাজির হল সে। বিশাল সাদা-কালো শরীরে নানারকম কসরত দেখাতে লাগল। দর্শকরাও তো এর জন্যই অপেক্ষা করেছিলেন। এ যে তাঁদের প্রিয় ‘কেটো’র খেলা। ওকে দেখতে আসবে না কেউ, তা হয় নাকি কখনও! কেটো আসলে অরকা প্রজাতির একটি ডলফিন। বিশাল চেহারার জন্য অনেক সময় তিমির সঙ্গেও গুলিয়ে ফেলা হয় একে। অবশ্য এই প্রজাতির আরও একটি ডাকনাম আছে, ‘দ্য কিলার হোয়েল’! বাধ্য কেটোও একসময় সেই ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।

সিওয়ার্ল্ড— নামটা শুনলেই মাথায় আসবে বিশাল সব ওয়াটার থিম পার্কের কথা। বিশ্বের নানা জায়গায় এই থিম পার্ক দর্শকদের মনোরঞ্জন করে চলেছে। তারই এক স্টার সদস্য কেটো। ওর মা, কালিনা সিওয়ার্ল্ড থিম পার্কের প্রথম অরকা ছিল। তারপর ১৯৯৫ সালে তার সন্তান কেটো’র আগমন। তখন থেকেই এখানের স্থায়ী বাসিন্দা সে। সমুদ্র, খোলা জায়গা নেই; তবুও জন্ম থেকেই এই থিম পার্ক, এই পুল এবং তার ট্রেনার— এটাই ছিল কেটো’র জগত।

সামুদ্রিক অরকা বা কিলার হোয়েলরা একটু খামখেয়ালি স্বভাবের হয়। ধারালো দাঁতও থাকে, মাঝে মাঝে আক্রমণও করে বসে। কাজেই ট্রেনারদেরও সাবধানে কাজ করতে হয়। এক্ষেত্রেও সেই কাজটাই খুব ভালোমতো হয়েছিল। কেটো-কে যারা খেলা শেখাত, যত্ন নিত তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অ্যালেক্সিস মার্টিনেজ। দিব্যি সবাই মিলে খেলা দেখাচ্ছিল। দর্শকদের কাছে রীতিমতো স্টার হয়ে যায় কেটো। সান ডিয়েগো, ওহিও, টেক্সাস-সহ নানা জায়গায় ঘুরে শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালে ক্যানারি আইল্যান্ড চলে আসে অরকা ডলফিনটি।

২০০৯ সালের ক্রিসমাস ইভ। রীতিমতো ভিড় জমেছে ওয়াটার পার্কগুলোতে। ক্যানারি আইল্যান্ডেও একই অবস্থা। দর্শকদের সামনে আসবে কেটো, আর তার ট্রেনাররা। সবই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ দর্শকদের মনে হল, কেটো যেন একটু অদ্ভুত আচরণ করছে। ট্রেনারদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। অ্যালেক্সিসও ছিলেন সেখানে। কেটো বেশ কয়েকটা খেলা ভুল করল; কিন্তু তাও সে শান্তই ছিল। বারবার অ্যালেক্সিস আর স্টেজটার সামনে চলে আসছিল। এমন সময় অ্যালেক্সিস জলে নেমে আসলে, সবটা গণ্ডগোল হয়ে যায়। কেটো নিজের বিশাল চেহারা দিয়ে ওকে জলের নিচে নিয়ে যায়। তারপরের ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। মুহূর্ত পরেই কেটো জলের ওপর উঠে আসে। তার ধারালো মুখে অ্যালেক্সিসের দেহ। তখনও বেঁচে আছেন তিনি। বাকি ট্রেনাররা ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাঁচানোর; কিন্তু কিছুই হল না। হাসপাতালে নিয়ে গেলে অ্যালেক্সিসকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

এই ঘটনার ঠিক দুই মাস আগে একই নৃশংস ঘটনা ঘটে ওয়াটার পার্কে। ডন ব্রানশাউ নামের এক মহিলা অরকা ট্রেনারের মৃত্যুর ঘটনা ছিল আরও ভয়ংকর। যে অরকা ডলফিনের সঙ্গে তিনি খেলা দেখাতেন, তার নাম তিলিকাম। বেশ গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল দুজনের। কিন্তু তাও কেন এমন হল, ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি কেউ। খেলা চলাকালীনই ডনকে জলের নিচে নিয়ে যায় তিলিকাম। যখন দেহ উদ্ধার করা হয়, দেখা যায় তাঁর বামহাতটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বেশ কিছু জায়গার চামড়া পর্যন্ত খুলে এসেছে। পাঁজর আর শিরদাঁড়া ভেঙে কয়েক টুকরো।

কেন এমন হয়, উত্তর খোঁজার চেষ্টায় চিকিৎসকরা। দীর্ঘদিন এই বদ্ধ জায়গায় থাকতে থাকতে কোনো মানসিক সমস্যা কি তৈরি হয় এই প্রাণীদের? যতই ওয়াটার পার্কে জন্ম হোক, কেটো, তিলিকামরা তো সামুদ্রিক জীবই।সেখানকার খোলা পরিবেশই তাদের জিনে বয়ে চলেছে। যাঁদের সঙ্গে এত সখ্য, এত গভীর সম্পর্ক, তাঁদেরকে কেন মেরে ফেলল? সব প্রাণীদেরই যে মন রয়েছে, সেটা তো আমাদেরই মনে রাখা উচিত…