ঠাকুরবাড়ির আনাচে-কানাচে চালু ছিল ভূত-প্রেতের গল্পগুজব

সূর্যস্নান।। পর্ব ২।।
'ছেলেবেলা' বইয়ের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্যকালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, এ যেন "অতীতের প্রেতলোকে" বিচরণ। কলকাতায় তখন সেকালের শেষ, একালের শুরু। দুই কালের মেশামেশি আর রেষারেষিতে সে এক মহা সন্ধিক্ষণ। কবি জানাচ্ছেন, "এখনকার সঙ্গে তার অন্তরবাহিরের মাপ মেলে না। তখনকার প্রদীপে যত ছিল আলো তার চেয়ে ধোঁওয়া ছিল বেশি। বুদ্ধির এলাকায় তখন বৈজ্ঞানিক সার্ভে আরম্ভ হয় নি…।" আর তাই, কোনটা সম্ভব আর কোনটা যে অসম্ভব, তার একটা স্পষ্ট সীমারেখা খুঁজে বার করা তখন ভারী মুশকিলের কাজ ছিল।

তখন কলকাতা শহরে গ্যাসের আলোও আসেনি, বৈদ্যুতিক বাতি তো ঢের পরের কথা। কেরোসিনের আলো পরে যখন এল, তার তেজ দেখে বালকেরা অবাক মানলেন। রোজ সন্ধ্যাবেলায়, ঠাকুরবাড়ির ঘরে ঘরে এসে ভৃত্যরা জ্বালিয়ে যেত রেড়ির তেলের আলো। শিশুদের পড়বার ঘরে জ্বালানো হত দুই সলতের একটা সেজবাতি।
আলোর যেখানে অভাব, সেখানেই তো ভয়! আর যেখানে ভয়, সেখানেই যে ভূত - এ কথা কে না জানে!

মাস্টারমশায় মিটমিটে আলোয় বালকদের পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্স্টবুক। রাত্রি ন'টা বাজলে ঘুমের ঘোরে ঢুলু ঢুলু চোখে ছুটি পেতেন শিশু রবীন্দ্রনাথ। বাহিরমহল থেকে বাড়ির ভিতর যাবার সরু পথটা ছিল খড়খড়ির আব্রু দেওয়া, উপর থেকে ঝুলত মিটমিটে আলোর লণ্ঠন। সেই আধো-আলো আধো-অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কবি যখন হাঁটতেন, খালি খালি তাঁর মন বলত - কী জানি, কেউ পিছু ধরল না তো! বালকের পিঠ শিউরে উঠত অজানা ত্রাসের তাড়নায়।

রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, "তখন ভূত প্রেত ছিল গল্পে-গুজবে, ছিল মানুষের মনের আনাচে-কানাচে।" ঠাকুরবাড়ির কোনও দাসী কখন হঠাৎ শুনতে পেত শাঁকচুন্নির নাকি সুর, ভয়ের চোটে সে দড়াম করে পড়ত আছাড় খেয়ে। ওই মেয়ে-ভূতটা ছিল সবচেয়ে বদমেজাজি। মাছের ওপর ভারী লোভ ছিল তার।

ঠাকুরবাড়ির পশ্চিম কোণে ছিল ঘন পাতায় ঢাকা একখানা বাদামগাছ, তারই একটি ডালে এক পা রেখে, অন্য পা'টা তেতালার কার্নিসের ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকত কোনো একটা অশরীরী মূর্তি। লোকশ্রুতি অনুযায়ী সে আর কেউ নয়, আস্ত এক ব্রহ্মদৈত্য। বিস্তর লোকে দাবি করত, তারা নাকি সেই ব্রহ্মদৈত্যকে একেবারে চাক্ষুষ দেখেছে। আর সে কথা মেনে নেবার লোকও কম ছিল না। ভূতের ভয় তখন মানুষের মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শেকড় গেড়ে বসেছিল।

এই ব্রহ্মদত্যির গুজবের বিষয়েই রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, "দাদার এক বন্ধু যখন গল্পটা হেসে উড়িয়ে দিতেন তখন চাকররা মনে করত লোকটার ধর্মজ্ঞান একটুও নেই, দেবে একদিন ঘাড় মটকিয়ে, তখন বিদ্যে যাবে বেরিয়ে।" অর্থাৎ, এই ব্রহ্মদত্যির সূত্রে সেকাল আর একালের দুই রকম মননের মধ্যে লাগত টক্কর। একদিকে ছিল প্রাচীনপন্থী, অল্পশিক্ষিত চাকরদের "ধর্মজ্ঞান", যে জ্ঞান তাদের প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াই অলৌকিক, অবাস্তবের প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে রাখতে শেখায়। আর একদিকে নব্যশিক্ষিত যুবকের যুক্তিবাদী "বিদ্যে", যার মধ্যে নাস্তিকতার রেশ রয়েছে, যা এইসব অপ্রত্যক্ষ গল্পগুজবকে হেসে উড়িয়ে দেয়। লক্ষ্যণীয় এই যে, যুক্তিতে না পেরে সেকেলে চাকর সম্প্রদায় মনে-প্রাণে আশা করত, ব্রহ্মদত্যি মশায় একদিন লোকটার ঘাড় মটকিয়ে দিলে বেশ হয়! ব্যাটার সব "বিদ্যে" নিষ্ফল প্রমাণ করার আর উপায়ই বা কী!

তবে এই যুক্তিবাদ আর অবিশ্বাস নব্যশিক্ষিত যুবকদের যতই আধুনিকপন্থী করে তুলুক, তখনকার দিনের বালক-বালিকাদের মনে কিন্তু তা প্রভাব ফেলতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করছেন, "সে সময়টাতে হাওয়ায় হাওয়ায় আতঙ্ক এমনি জাল ফেলে ছিল যে, টেবিলের নীচে পা রাখলে পা সুড়সুড় করে উঠত।"

তখনও কলকাতায় জলের কল বসেনি। বেহারার দল কাঁখে ক'রে কলসি ভরে মাঘ-ফাল্গুন মাসের গঙ্গার জল তুলে আনত। একতলার অন্ধকার ঘরে সারি সারি বড়ো বড়ো জালায় ভরা থাকত সারা বছরের খাবার জল। নীচের তলার সেই-সব স্যাঁৎসেতে এঁদো কুঠুরিতে গা ঢাকা দিয়ে যারা বাসা করেছিল, তারা যে এক-একটি আস্ত কন্ধকাটা, তা নিয়ে শিশুদের মনে সন্দেহমাত্র ছিল না। বালক রবি ভালোরকম জানতেন, সেইসব প্রেতমূর্তির "মস্ত হাঁ, চোখ দুটো বুকে, কান দুটো কুলোর মতো, পা দুটো উলটো দিকে।" সেই ভূতুড়ে ছায়ার সামনে দিয়ে যখন কবি বাড়ির ভিতরের বাগানে যেতেন, তাঁর বুকের ভেতরটা ভয়ে তোলপাড় করে উঠত। কোনওরকমে তাড়াতাড়ি পা ফেলে সেখান থেকে ছুট লাগাতেন সন্ত্রস্ত শিশু।

এ প্রসঙ্গে জীবনস্মৃতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির আর পাঁচজন শিশুর মতোই তাঁর শৈশব কেটেছিল ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে, আর তাদের হাত থেকে প্রায়ই মারধোর জুটত শিশুদের কপালে। মার খেয়ে কান্নাকাটি করলে সেটা "ভৃত্যরাজদের বিরুদ্ধে সিডিশন" হিসাবে গণ্য হত। কবি জানাচ্ছেন, "আমার বেশ মনে আছে, সেই সিডিশন সম্পূর্ণ দমন করিবার জন্য জল রাখিবার বড়ো বড়ো জালার মধ্যে আমাদের রোদনকে বিলুপ্ত করিয়া দেবার চেষ্টা হইত।"

স্নেহহীন, মমত্বহীন রুক্ষ ভৃত্যরা অবাধ্য শিশুদের কান্না থামাবার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায়টিই বেছে নিয়েছিল- ভীতি প্রদর্শন। আমরা বেশ বুঝতে পারি, এই প্রচণ্ড নিরুপায় ভয় থেকেই কবি ও তাঁর সমবয়সী বালকদের শিশুমন সেই আধো-অন্ধকার কুঠুরিগুলির মধ্যে অ-স্বাভাবিক অলৌকিক জীবেদের অস্তিত্বের কল্পনাকে এত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিল। ভয়ের মধ্যে ভূতের বাস, সন্দেহ কী!

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'কঙ্কাবতী' উপন্যাসের এক জায়গায় বলেছিলেন, জল জমে যেমন বরফ হয়, তেমনি মানুষের মনের অন্ধকার জমাট বেঁধে ভূতের সৃষ্টি হয়। কথাটা পরিহাসের সুরে বলা হলেও, এর ব্যঙ্গর্থটি বড়ো গভীর, বড়ো গা-শিরশিরে।

প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ তাঁর শৈশবের কথা, "অতীতের প্রেতলোকে"-র কথা বলতে বলতে পাঠকদের জানাচ্ছেন,

"সেই বাদামগাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু অমন পা ফাঁক করে দাঁড়াবার সুবিধে থাকতেও সেই ব্রহ্মদত্যির ঠিকানা আর পাওয়া যায় না।

ভিতরে বাইরে আলো বেড়ে গেছে।"

আলো বাড়ুক। আলো আমাদের সকলের দরকার, ভীষণ দরকার!

Latest News See More