শ্বশুরের সম্পত্তির দাবিতে মামলা ত্রিপুরাসুন্দরীর; ঠাকুরবাড়ির যে মনোমালিন্য গড়িয়েছিল আদালতেও

কলকাতার চাঁদপাল ঘাট। ১৮৪৫ সালের মার্চ মাস। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপকে সঙ্গী করে পি অ্যান্ড কোম্পানির বেন্টিক জাহাজ অতল সমুদ্রে ভেসে পড়ল লন্ডনের উদ্দেশ্যে। সওয়ারি দ্বারকানাথ ঠাকুর। সঙ্গে রয়েছেন ‘আদুরে ছেলে' নগেন্দ্রনাথ এবং ভাগনে নবীনচন্দ্র। সেবার আর দেশে ফিরতে পারেননি নগেন্দ্রনাথ। ১৮৪৬ সালের ৩১ জুলাই রাত্রে লন্ডনেই মারা যান দ্বারকানাথ। তাঁর শেষযাত্রাও হয় রাজকীয় পদ্ধতিতে। মরদেহ বহনের জন্য চারজন কফিন বাহক পাঠিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া স্বয়ং। 

এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন দ্বারকানাথের 'আদুরে ছেলে'। বাবার প্রায় বৈশিষ্ট্যই বর্তমান ছিল নগেন্দ্রনাথের মধ্যে। অন্যদিকে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরে ঐতিহ্যশালী ঠাকুরবাড়ি একপ্রকার মুখ থুবড়ে পড়ল। এমনকি দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর তার শ্রাদ্ধ শান্তি বিষয়েও তুঙ্গে উঠল মতবিরোধ। এমনকি এরই সূত্র ধরে জোড়াসাঁকো এবং পাথুরিঘাটার ঠাকুর পরিবারের মধ্যে বন্ধ হল মুখ দেখাদেখি। 

নগেন্দ্রনাথ লন্ডনের উঁচুমহলে চলাফেরা করতেন। এমনকি এও জানা যায়, ডাচেস অফ সান্ডারল্যান্ডের মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও নাকি তৈরি হয়েছিল নগেন্দ্রনাথের। নগেন্দ্রনাথও দ্বারকানাথের মতোই আমোদ-প্রমোদে মত্ত হয়ে পড়েন বিলেত যাত্রার কিছুকালের মধ্যে, যে অভ্যাস তিনি দেশে ফিরেও ত্যাগ করতে পারেননি। দ্বারকানাথ নিজে ছিলেন পুত্রস্নেহে অন্ধ। ফলে নগেন্দ্রনাথকে বাধা দেবার চেষ্টার কথা ভুলেও ভাবেননি তিনি। স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিনের মধ্যেই ঋণের চক্রব্যুহে আটকে পড়লেন নগেন্দ্রনাথ। শুরু হলো পাওনাদারদের তাগাদা। 

নিরুপায় নগেন্দ্র হাত পাতলেন দেবেন্দ্রনাথের কাছে। অন্যদিকে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি সদস্যই কমবেশি দিশেহারা। এ প্রসঙ্গে সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর জানাচ্ছেন - "দ্বারকানাথের মৃত্যুর বছর দুইয়ের মধ্যে পরিবারের ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক ইত্যাদি একে একে লাটে উঠল।" ফলে দেবেন্দ্রনাথ নগেন্দ্রনাথকে সাফ জানিয়ে দিলেন, ঋণের বোঝা বইতে তিনি রাজি নন। তবে পাশাপাশি নগেন্দ্রনাথকে তিনি পরামর্শ দেন গালিমপুরের রেশমকুঠির ইজারা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করার। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথেরর প্রস্তাব পছন্দ হয়নি নগেন্দ্রর। একদিকে পিতার মৃত্যুশোক অন্যদিকে মাথায় ঋণের বোঝা - অভিমানে বাড়ি ছাড়লেন তিনি। আশ্রয় মিলল কয়লাহাটার রমানাথ ঠাকুরের বাড়িতে। সেখানেই শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় নগেন্দ্রনাথের। 

আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির সরলাকে ‘আধ্যাত্মিক স্ত্রী’ হিসেবে চেয়েছিলেন গান্ধীজি, পিছিয়ে আসেন কস্তুরবার চাপে

নগেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ঠিক হয় তার স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীকে মাসোহারা দেওয়া হবে দুশো টাকা এবং তার সমস্ত ব্যায়ভার বহন করবে ঠাকুর পরিবার। কিন্তু ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেন তাঁর ভাইয়ের সাহায্যে। সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ-প্রসঙ্গে লিখছেন - "...ভাই কেদার মজুমদারের পরামর্শে দ্বারকানাথের সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের দাবি করে হাইকোর্টে মামলা রুজু করেন।"

এই মামলাকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের অবনতি এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী জোড়াসাঁকোর ছয় নম্বর বাড়িতে জলগ্রহণ পর্যন্ত করতেন না। এমনকি তাঁর আশঙ্কা ছিল ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা তাকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করতে পারেন। যদিও শেষ পর্যন্ত বরফ গলে। ত্রিপুরা দেবীর সঙ্গে আপোস রফা করতে বাধ্য হলেন দেবেন্দ্রনাথ, কারণ তার ভয় ছিল এই মামলার খবর যদি একবার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তা আলোচনার জন্য অন্যতম মুখ্য বিষয় হয়ে উঠবে সাধারণ মানুষের কাছে। উনিশ শতকের বুকে দাঁড়িয়ে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের মনোমালিন্য গড়িয়েছে কোর্ট পর্যন্ত - ভয়ের কারণটা সহজেই অনুমেয়। শেষ পর্যন্ত ত্রিপুরাদেবীকে সার্কুলার রোডের জোড়া গির্জার বাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে মামলা তুলে নেন তিনি এবং পরবর্তীকালে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করা হয়। 

আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির আনাচে-কানাচে চালু ছিল ভূত-প্রেতের গল্পগুজব

ঊনবিংশ শতকের ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে যেমন প্রবাহিত হয়েছিল রেনেসাঁসের হাওয়া তেমনি প্রায় একই সময়ে জোড়াসাঁকোর পাঁচ ও ছয় নম্বর বাড়ির মধ্যে আভাস পাওয়া গেছে সম্পর্ক ভাঙাগড়া এবং তার সূত্র ধরে মামলা-মোকদ্দমারও। যার কারণ ছিল কখনো দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধশান্তির প্রক্রিয়া কখনো বা নিছকই সম্পত্তি। যা চাপা পড়ে আছে ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণের হাজারো আলোর নিচে।  ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি এমন কতশত ঘটনা। আমরা কি তার হিসেব রাখি?

তথ্যসূত্র - 'ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা' - সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আরও পড়ুন
মাড়োয়ারির কাছে বিক্রি হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, অভিমানে আর ফিরলেন না অবনীন্দ্রনাথ

Powered by Froala Editor

More From Author See More